নাবালিকা স্ত্রীর সঙ্গে যৌন সম্পর্ক ও বাল্য বিবাহ নিরোধ আইন,১৯২৯

Monday, October 7, 2013

01_124 সিরাজ পরমানিক

বাংলাদেশ দন্ডবিধি আইনের ৩৭৫ ধারার ব্যতিক্রমে বলা হয়েছে, ‘১৩ বছরের কম বয়সী স্ত্রীর সঙ্গে যৌন সম্পর্ক স্থাপন ধর্ষণের শামিল হবে। এ ক্ষেত্রে নাবালিকা বধূর সম্মতি থাকুক বা না থাকুক। বিশ্বের অনেক উন্নত দেশের আইনে প্রাপ্তবয়স্ক স্ত্রীর সঙ্গে তাঁর ইচ্ছার বিরদ্ধে যৌন সম্পর্ক ধর্ষণের শামিল হলেও আমাদের দেশের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে এ ব্যাপারে কিছু উল্লেখ করা হয়নি।


দরিদ্র পরিবারের সপ্তম শ্রেণীতে পড়ুয়া মেয়ে ছন্দা (ছদ্মনাম) ২০০৮ সালের ১১ মে কুষ্টিয়া নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আদালতে এসে একটি মামলা করেন। তার আপন খালু রহিম মিয়া, খালা সাজেদা আক্তার, মূল আসামী খালেক সহ মোট ছয়জনের বিরুদ্ধে অপহরণ ও ধর্ষণের অভিযোগে মামলা করে। মামলার নালিশে আরজিতে উল্লেখ করা হয়, মূল আসামি খালেক শেখ (৫৫) তাঁর সঙ্গে বিয়ে দেওয়ার জন্য মেয়েটির খালা-খালুকে টাকা-পয়সা দিয়ে হাত করেন। ঘটনার তারিখে মেয়েটির বাবা তাঁর ব্যক্তিগত কাজে বাড়ির বাইরে অবস্থান করছিলেন। এ সুযোগে আসামি খালেক শেখ তার অসৎ উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য মেয়েটির খালা-খালুসহ সন্ধ্যা সাতটায় তাদের বাড়িতে আসেন এবং নিকাহ রেজিস্ট্রার আসামি আরব বিশ্বাস ও মাওলানা আইয়ুব আলীকে ডেকে রাত আটটায় বিয়ে পড়ানোর কাজ সম্পন্ন করেন। ওই সময় মেয়েটির মা উপস্থিত ছিলেন এবং তাঁর সম্মতিতে দাদার বয়সী লোকের সঙ্গে মেয়েটির বিয়ে সম্পন্ন হয়। অতঃপর আসামিরা মাইক্রোবাস ভাড়া করে মেয়েটিকে কুষ্টিয়ার কুমারখালী শহরের কুণ্ডুপাড়ার বসতবাড়িতে নিয়ে আসেন। ওই দিন রাতে আসামি খালেক শেখ জোর করে তাঁর নাবালিকা স্ত্রী (১৩) ছন্দার সঙ্গে যৌন সম্পর্ক স্থাপন করতে চাইলে অপ্রাপ্তবয়স্ক শিশু মেয়েটি ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে প্রচণ্ডভাবে বাঁধা দেয়। আসামি খালেক শেখ যৌন সম্পর্ক স্থাপনের জন্য চাপাচাপি ও বল প্রয়োগের এক পর্যায়ে ভিকটিমকে চড়-থাপড় মারেন। মামলার ঘটনা থেকে আরও জানা যায়, অতঃপর মেয়েটিকে ঢাকার গাবতলীর একটি বাসায় নিয়ে যান এবং সেখানেও অনুরূপভাবে জোরপূর্বক যৌন সম্পর্ক স্থাপন করেন। পরের দিন সুযোগ বুঝে ঢাকার গাবতলীর ওই বাসা থেকে মেয়েটি পালিয়ে ঢাকার মহিলা আইনজীবী সমিতিতে আশ্রয় নেয় এবং রমনা থানায় একটি জিডি এন্ট্রি করে।


মেয়েটি ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে ২০০৮ সালের ৩০ অক্টোবর উপরিউক্ত ঘটনা উল্লেখ করে আরও বলে, আসামির আরও দুটি স্ত্রী আছে। মামলার শুনানীকালে আরও জানা যায়, মেয়েটির পরিবারে হতদরিদ্রতার সুযোগে আসামি খালেক শেখ মেয়েটির পরিবারের নামে জমি দেওয়ার প্রলোভন দিয়ে তৃতীয় বিবাহ করেন। মেয়েটির সাথে ওই আসামীর বিয়ে হওয়ায় এবং পরবর্তীতে আপোষ সাক্ষ্য দেয়ায় আসামি খালেককে অপহরণ ও ধর্ষণের দায়ে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে দোষী সাব্যস্ত করে আদালত সাজা দিতে পারেনি।


আমাদের দেশে এ ধরনের নাবালিকা বিয়ে হরহামেশা হচ্ছে। বিশেষ করে হতদরিদ্র পরিবারগুলোয় এ ধরনের নাবালিকা বিয়ের প্রবণতা খুব বেশি লক্ষ্য করা যায়। হতদরিদ্র পরিবারগুলোর অভিভাবকদের অশিক্ষা, সচেতনতার অভাব, ধর্মীয় গোঁড়ামি, ভরণপোষণ দেওয়ার অক্ষমতা ও সামাজিক নিরাপত্তাহীনতার কারণে সাধারণত অল্প বয়সী মেয়েদের বিয়ে দিয়ে থাকেন এবং তাদের স্বামী কর্তৃক যৌন হয়রানির শিকার হয়ে থাকে। ফলে আইন না জানা কিংবা লোকলজ্জা ও সামাজিক অনিরাপত্তার কারণে দিনের পর দিন এদেশের নাবালিকা বধূরা যৌন নির্যাতন সহ্য করে যাচ্ছে।


বাল্য বিবাহ প্রশ্নে তিন পক্ষই সমান অপরাধী

ক) ‘বাল্য বিবাহ’ বলতে ওই বিবাহকে বুঝাবে যাতে পক্ষদ্বয়ের যে কোন একজন ‘শিশু’ বা নাবালক হবে।

খ) ‘শিশু’ বা নাবালক বলতে ওই ব্যক্তিকে বুঝাবে যার বয়স পুরুষ হলে ‘একুশ’ বৎসরের নিচে এবং স্ত্রী হলে ‘আঠারো’ বৎসরের নিচে হবে;

গ) ‘বিবাহের পক্ষ’ বলতে যে দুই জনের মধ্যে বিবাহ অনুষ্ঠিত হয়েছে, অথবা হতে চলেছে এমন যে কোন একজনকে বুঝাবে;

বিয়ে মানুষের জীবনের সবচেয়ে সুখকর অনুভূতি ও প্রজন্ম বিস্তারের একমাত্র উপায় হলেও কখনও কখনও তা অভিশাপ রূপে দেখা দেয়। বিশেষ করে যখন সেটি বাল্যবিবাহের পর্যায়ে পড়ে। এটি আইনত নিষিদ্ধ হলেও হরহামেশাই হচ্ছে। যার পরিণতিতে কিশোরী মায়েরা পড়ছে নানারকম স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে। ঘটছে মৃত্যুর ঘটনাও। বিশ্বের যে ক’টি দেশে বাল্যবিবাহের হার বেশি, এর মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম।


বাংলাদেশে বিশেষ করে গ্রামীণ এলাকায় বাল্যবিবাহের প্রচলন খুব বেশি। কারণ গ্রামের দরিদ্র মানুষরা তাদের দারিদ্র্য থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য অল্প বয়সে মেয়েদের বিয়ে দেয়। আবার কেউ কেউ কাজের লোকের অভাব পূরণের জন্য অল্প বয়সের ছেলেকে বিয়ে করান। এ রকম আরও অনেক কারণে গ্রামে বাল্যবিবাহের বিস্তার ঘটে। সরকার অবৈতনিক শিক্ষা চালু করা, উপবৃত্তি ইত্যাদি ব্যবস্থা করার পরও এর হার কমছে না। বাংলাদেশে ১৮ বছর বয়স হওয়ার আগেই ৬৬ শতাংশ মেয়েদের বিয়ে দেয়া হয় এবং গত দুই দশক এর হার প্রায় একইভাবে এগিয়ে যাচ্ছে।


ইউএনএফপি’র গবেষণা মতে, উন্নয়নশীল দেশে ১০ থেকে ১৭ বছর বয়সী ৮ কোটি ২০ লাখ কন্যাশিশুর বিয়ে হয় প্রাপ্ত বয়স্ক হওয়ার আগে। আর এরাই মানসিক, শারীরিক ও যৌন জীবন ক্ষতির সম্মুখীন হয়। বাল্যবিবাহের কারণে স্কুল থেকে ঝরে পড়ার হার বাড়ছে এবং এর ফলে সামাজিক যোগাযোগের সুযোগ কমছে। বিয়ের পর স্বামীর সংসারে কায়িক পরিশ্রমের কারণে প্রায় ৫৫ শতাংশ কন্যাশিশু মাধ্যমিকে ঝরে পড়ে। তাদের গবেষণায় আরও দেখা যায়, কন্যাশিশুকে সামাজিক নিরাপত্তা না দিতে পারা, বিয়ের প্রস্তাব বা কু-প্রস্তাবে রাজি না হওয়ায় এসিড সন্ত্রাসের শিকার হওয়ার ভয়েও বাল্যবিবাহ দেয়া হয়। পরিস্থিতির ভয়াবহতা আরও বাড়ছে যখন দেখা যাচ্ছে, ৭০ শতাংশ ক্ষেত্রে বরের বয়স ১৮ বছরের নিচে এবং ২৬ শতাংশ ক্ষেত্রে কনের বয়স ১৩ বছরের মধ্যে।


বাল্য বিবাহের শাস্তি

এক মাস মেয়াদ পর্যন্ত বিনাশ্রম কারাদন্ড কিংবা এক হাজার টাকা পর্যন্ত জরিমানা অথবা উভয় প্রকারের দন্ডই হতে পারে। এ শাস্তি বাল্য বিবাহকারীর, বিবাহ সম্পন্নকারীর এবং অভিভাবকের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। অর্থাৎ বিবাহ আয়োজনকারী, যারা বিবাহ আয়োজনে জড়িত থাকবে তাদের ক্ষেত্রেও এই শাস্তি প্রযোজ্য। এ আইনে সংঘটিত কোন অপরাধ সম্পূর্ণরূপেই ফৌজদারী অপরাধ। সুতরাং নিঃসন্দেহে এর বিচার পদ্ধতি ফৌজদারী কার্যবিধি আইনের আওতাভুক্ত। ফৌজদারী কার্যবিধির ২৬০(এফ) (ক) ধারার অধীন অনূর্ধ্ব ছয় মাস মেয়াদের কারাদন্ডযোগ্য অপরাধগুলির বিষয় সংক্ষিপ্ত পদ্ধতিতে অনুষ্ঠিত হবে। এ জন্য বাল্য বিবাহ নিরোধ আইনের কোন অপরাধ সংঘটিত হলে এর বিচার ফৌজদারী কার্য বিধি আইনের ২৬০(ক) ধারার আওতাভূক্ত হবে।


বাল্য বিবাহ নিরোধ কল্পে নিকাহ রেজিষ্ট্রার বা কাজী সাহেবের দায়-দায়িত্ব

১. নিকাহ রেজিষ্ট্রার বা কাজী বা পুরোহিত বিবাহ সম্পন্ন করার পূর্বে ছেলে ও মেয়ের বয়স সম্পর্কে যুক্তিসংগত অনুসন্ধান করবে এবং এই মর্মে পরিতুষ্ট হবে যে, বর বা কনের কেউ শিশু বা নাবালক নয়।

২. বর ও কনের বয়স সম্পর্কে নিশ্চিত না হয়ে কাজী সাহেব বিয়ে রেজিষ্ট্রি করবে না। এ ব্যাাপারে কাজী সাহেব, ইমাম সাহেবদের বিয়ে পড়ানো থেকে বিরত থাকার পরামর্শ দিবে।

৩. কাজী সাহেব বয়স নিশ্চিত হবার জন্য বর ও কনে উভয়েরই বয়সের সার্টিফিকেট চেতে পারে। অর্থাৎ বয়স নিশ্চিত হবার জন্য কাজী সাহেব যে কোন প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে পারবে। প্রচলিত মুসলিম পারিবারিক আইন অনুযায়ী অর্থাৎ ১৯৭৪ সালের মুসলিম বিবাহ ও তালাক রেজিষ্ট্রেশন আইনানুযায়ী কাজী সাহেবকে ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে।

৪. কাজী সহেব বাল্য বিবাহের আইনগতদিক তুলে ধরে জনগণের মধ্যে সচেতনতার সৃষ্টি করবে। বাল্য বিবাহের ফলে ব্যক্তি এবং সমাজ জীবনে কি কি খারাপ প্রভাব পড়ে সে ব্যাপারে কাজী এবং স্থানীয় চেয়ারম্যান সাহেবসহ সমাজের সবাই সচেতন ব্যক্তিগণ সচেতনতা সৃষ্টি করবে।


লেখকঃ সাংবাদিক, আইনগ্রন্থ প্রণেতা, এম.ফিল গবেষক ও আইনজীবী জজ কোর্ট, কুষ্টিয়া। ই-মেইল: seraj.pramanik@gmail.com মোবাইল: ০১৭১৬-৮৫৬৭২৮





Share on :

No comments:

Post a Comment

 
Copyright © 2015. Sylhet News.
Design by Herdiansyah Hamzah. Published by Themes Paper. Distributed By Kaizen Template Powered by Blogger.
Creative Commons License