আমরা ছোট বেলায় শুনেছি বয়স্কদের মুখ থেকে চৌষট্রি পয়সায় টাকার কথা। তবে আমরা তা বাস্তবে দেখতে পারিনি। কিন্তু হিসাবের ক্ষেত্রে তাঁদের মুখ থেকে শুনতাম এ জাতীয় কথা। যেমন আমরা বলতাম সাড়ে তিন আনা। তখন বড়রা বাধাঁ প্রদান করে বলতেন চৌদ্দ পয়সা। আমরা পেলাম টাকা আনা পাই এর হিসাব। চতু:স্কোণ বিশিষ্ট লাল রঙ্গের ( বলা হত তামার তৈরী) পাঁচ পয়সার সহিত গোলাকার এক পয়সা মিলে হত এক আনা। গোলাকার খাঁজ কাটা দশ পয়সার সহিত গোলাকার খাঁজ কাটা দুই পয়সা মিলে হত দুই আনা। সিকি , আধুলীর প্রচলন ছিল। সিকি বলতে চার আনা , আধুলী বলতে আট আনা বুঝানো হত। অত:পর ছিল এক টাকার কয়েন। এ কয়েনকে বলা হত কাঁচা টাকা। প্রতিটি কয়েনকে পরখ করা যেত অনায়াসে। একটি থেকে আরেকটির ব্যবধান সহজেই পরিমিত বা পরখ করা যেত। বর্তমানের মত এত জটিলতা ছিল না পরখ করার ক্ষেত্রে। আজ আর শুনি না সিলেট শহরের কীন ব্রীজের উভয় পার্শে ঢালা গলায় নিয়ে ফেরিওয়ালারা বলতে , “ বেলেট এখান এক আনা গো , সুই বান্ডুল এক আনা”। -এক আনার দিন গিয়েছে ফুরিয়ে। কয়েক বৎসর পূর্বে এক পয়সা , দুই পয়সা , পাঁচ পয়সা , দশ পয়সা ও সিকি চলে গিয়েছে নিরুদ্দেশের পথে পা বাড়িয়ে। হয়ত যাদুঘরে। ছিল আধুলি ও এক টাকার কয়েন এর প্রচলন। কিন্তু ইদানিং পরিলক্ষিত হয় কেহই আধুলির বিনিময়ে অক্ষমতা প্রকাশ করতে। অর্থ্যাৎ কেহ কাহাকে আধুলি দিতে চাইলে নিতে রাজি নয়। অবস্তা দৃষ্টে মনে হয় তা ও গিয়েছে নির্বাসনের পথে। স্মৃতি আয়নায় দেখি শুধু সাঁতার কেটে। আজ অনেক ক্ষেত্রে আনা পাই এর নাম বা প্রচলন হয়েছে উধাও। শুনতাম হকারের হাকডাক চা বিস্কুট এক আনা। পাই থেকে পয়সায় উন্নীত। সর্বজন বিদিত এখন টাকার হিসাব অবস্তা দৃষ্টে তাই মনে হয়। এক টাকা ও যেন হিসাব বহির্ভুত হয়ে গেছে।
আমরা দেখেছি মণ , সেরের হিসাব। এক মণ সমান চল্লিশ সের। সেরের একাংশ বলতে আমরা বুঝতাম ছটাক , কাচচা , তোলার হিসাব। আজ সেখান থেকে উত্তোরণ হয়ে হয়েছে কেজি , গ্রামে। সাড়ে সাইত্রিশ কেজিতে এক মণ বলা হয়ে থাকে এবং তা বাস্তবে ও বাস্তবায়িত সর্বক্ষেত্রে। আজ সে সকল বাসি বলেই প্রতীয়মান। এ প্রজন্ম জানবে না সে সম্পর্কে।
বাংলাদেশ একটি নদী মাতৃক দেশ। জালের ন্যায় এ দেশকে নদী বেষ্টন করে রেখেছে বলেই নদী মাতৃক নাম দেয়া হয়েছিল। কিন্তু বর্তমানে নদী ভরাট হয়ে যাবার ফলে এবং নদীর নব্যতা হারিয়ে নদীগুলি যেন হয়ে গেছে খালে রুপান্তরিত। কোথাও আবার নদীর চিহ্নই হয়ে গেছে বিলীন। নদী , নৌকা , পাল , মাঝি , বৈঠা ইত্যাদি নিয়ে কত কালোত্তীর্ণ গান , কবিতা করেছেন রচনা আমাদের পূর্ব পুরুষরা , হয়েছেন খ্যাতিমান। কৃষি প্রধান এ দেশে নদীর গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। কিন্তু নদী হারিয়ে যাবার বা ভরাট হবার ফলে এবং কোথাও মানুষ নদী ভরাট করে আবাস ভুমি বা দোকান কোটা তৈরীর প্রেক্ষিতে দিনে দিনে হচেছ ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর। এক সময় বিলীন। আমরা জাতি হিসাবে কথা বলি বেশি এবং কাজ করি কম। অপরাপর জাতি চলে তার বিপরীত ¯্রােতে। নদী খনন এর কথা প্রায়শই শুনি। কিন্তু কাজের বেলায় চিচিং ফাঁক। যেমন এ দেশে অপরিকল্পিত ভাবে গড়ে উঠছে বাসা-বাড়ি। এ দিকে আমাদের জ্ঞানী গুনীদের ভ্রুক্ষেপ নেই। ফসলী জমি হচেছ আবাস ভুমি। সরকার যদি রয়েলিটির বদলে নদী থেকে বালু বা মাটি উত্তোলনের সুযোগ দিতেন , তবে একদিকে নদী হত খনন , অপর দিকে সরকারের কোষাগারে অর্থ যোগানে অর্থনৈতিক ফায়দা হত হাসিল। সরকার নদী খননের কথা বললে ও তা বাস্তবায়িত হয় না ( সবক্ষেত্রে নয়) বললে অত্যুক্তি হবে না বলে মনে হয়। নদী খননের কথা বলা হলে ও অনেক ক্ষেত্রে ভুমি খেকোরা তা দখল করে ভরাটের মাধ্যমে ( সবক্ষেত্রে নয় ) আমাদের জাতীয় ভাবে করা হচেছ ক্ষতিগ্রস্থ। সে দিকে কারো খেয়াল নেই বলে আমার ধারণা। নদীগুলি খনন করা না হলে আবাদ ভুমি হবে পতিত জমিতে রুপান্তরিত। অথবা বিরান ভুমি।
আমরা দেখেছি বিশ্বনাথের খাজাঞ্চী নদী দিয়ে অনেক অনেক রং বেরঙ্গের নৌকা চলাচলের দৃশ্য। হাটবারে অসংখ্য নৌকা থাকত নদীতে পাশাপাশি অবস্তানে। আজ এ নদী তার জৌলুস হারিয়ে খালে হয়েছে পরিণত। নদীতে যেমন নৌকা দেখা যায় না। তেমনি নদীর পূর্বের জৌলুস ও তরঙ্গায়িত ঢেউ হয়েছে বিলুপ্ত। চলত অনেকগুলি লঞ্চ। চলত বাঁশের চাল ( চাইল)।- পাহাড়ী এলাকা হতে বাশঁ এনে এক শ্রেণীর মানুষ ডাম , দাডা ইত্যাদি তৈরী করে বাজারে বিক্রি করে জীবিকা করতেন নির্বাহ। এ সকল আজ স্বপ্নসম।
গ্রামে ছিল না বিদ্যুৎ। গ্রামের মানুষের ধারণা ছিল বিদ্যুৎ শহরের নিমিত্তে আবিষ্কৃত। আলো জ্বালাতেন কুকি বাতি , হারিকেন ইত্যাদির মাধ্যমে। ছিল না ডাক্তার। গ্রামের মানুষ সাধারণত ঝাড় ফুঁকের উপর ছিলেন নির্ভরশীল। তাছাড়া বনের মধ্যে থাকা বিভিন্ন প্রকার লতাপাতার নির্যাস দ্বারা করে নিতেন চিকিৎসা। তাদ্বারা ফলাফল ও পেতেন ষোল আনা। আবার ডাক্তারে গেলে পুরো ইন্টারভিউ দিতে হত চিকিৎসককে। রোগের আদ্যোপান্ত জেনে নাডি একবারের দেখায় হত না। দেখতেন বার বার। জানতেন রোগের পুরো ইতিহাস। অত:পর পথ্য। কদাচিৎ রক্ত , পায়খানা পরিক্ষা করানো হত। যা ছিল নেইয়ের সমতুল। আজ ডাক্তার শ্রম , মেধা , অভিজ্ঞতা , দক্ষতা ব্যবহার করে পথ্য দেন না। ঔষধ দেন রোগিকে সাত ঘাটের পানি খাবানোর পর। টাকাকে জলের ন্যায় ব্যবহার করিয়ে। ডাক্তার সাহেব এর কোন প্রকার মেধা ব্যয় করতে হয় না। অমুক তমুক পরিক্ষা করিয়ে কলমের খোচায় লিখে দেন কাগজে ঔষধের তালিকা। ডাক্তার থেকে বেরুলে আরেক ঝামেলা পোহাতে হয় রোগিকে। সেটা হচেছ এক শ্রেণীর ঔষধ বিক্রয় প্রতিনিধি বাইরে থাকেন দাড়িয়ে ডাক্তার তিনির কোম্পানীর ঔষধ প্রেসক্রিপশনে লিখলেন কিনা তা দর্শনের নিমিত্তে। অনেক সময় রোগি বা তার আত্বীয় স্বজনের মন মানসিকতা ভাল থাকে না। এ সময় প্রেসক্রিপশন দেখানো বা সময় প্রদানের স্বল্পতা হেতু একটা বিব্রতকর পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে হয়। আমার মতে এ কাজটি একজন রোগি বা সে সময় সঙ্গে থাকা আত্বীয় স্বজনকে নির্যাতন তুল্য। এ থেকে অনেক রোগি পরিত্রাণ পেতে চায়। সুতরাং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সচেতনতা অবশ্যই অপরিহার্য। রোগে শোকে মানুষ থাকে অধিক কাতর। তাকে শান্তনার পরিবর্তে এ কাজগুলো অশান্তির কারন হয়ে দাড়ায় বলে আমার অভিমত।
ব্যাঙ্গের ছাতার ন্যায় গজিয়ে উঠা ক্লিনিক গুলি অনেক সময় ভুল রিপোর্ট প্রদান করে রোগির বাজায় বারোটা। ডাক্তাররা ও কম যান না। এইতো সেদিনের কথা। আমার এক মামার রোগ হয়েছে হাঁপানী। চলে গেছেন বড় একজন ডাক্তারের নিকট। তিনির প্রথম পরামর্শ হল। অমুক ক্লিনিকে ভর্তি হতে হবে এবং টাকা লাগবে কম পক্ষে ষাট হাজার। তিনি আবার প্রেসক্রাইভ করতেই নারাজ। যা হোক অনেক বলে কয়ে প্রেসক্রাইভ করানো হল , এই বলে যে দরিদ্র লোকটি টাকার যোগান করার পূর্ব পর্যন্ত যেন ঔষধ খেতে পারেন তার ব্যবস্তা এই আর কি ? রোগ কমার বা তিনির টাকা সংগ্রহের কোন ব্যবস্তা নেই। নিরুপায় হয়ে এসেছেন আমার কাছে আমি যেন তিনিকে নিয়ে ভাল একজন ডাক্তারের নিকট যাই। পড়লাম মহাফাপরে। আমি ডাক্তার ও নই , এ ব্যাপারে আমার আরো অনেক অভিজ্ঞতা যা ডাক্তার দেখানোর বিপক্ষে অবস্তানের কার্য কারন। আবার তিনিকে না নিয়ে গেলে ও “ জলে কুমির , ডাঙ্গায় বাঘ ” অবস্তা। সুতরাং নিরুপায় হয়ে চলে গেলাম আমার জানা মত ভাল এবং নাম করা একজন ডাক্তারের নিকট। অনেকক্ষণ বসার পর আসলেন ডাক্তার সাহেব। সিরিয়েল অনুসারে পৌছলাম তিনির নিকট। দেখালাম পূর্ব ডাক্তারের কাগজ পত্র। খচ খচ করে লিখলেন পাঁচটি পরিক্ষার কথা। কোন ঔষধ লিখলেন না। পরিক্ষা করালাম সাত হাজার টাকা ব্যয়ে। আবার দেখালাম রিপোর্টগুলি। বললেন ঔষধ লাগবে না। এ ক্লিনিকে ভর্তি করুন এবং টাকা নিদেন পক্ষে ষাট হাজার। কারন রোগির ফুসফসে পানি জমে গেছে। আমি বললাম আপনি ঔষধ লিখে দিন আমরা টাকা যোগাড করে আসব ক্লিনিকে এবং রোগিকে ভর্তি করাবো। অনিচছার ইচছায় লিখলেন দুই দিনের ঔষধ। আমার এক প্রকার উভয় ডাক্তারের কথা এক ও অভিন্ন হবার সুবাদে সত্যি বলে কথাগুলি মনে হলে ও রোগির কোন মতেই এ পরিমাণ টাকা যোগাড করা কস্মিন কালে ও সম্ভব নয় বিধায় আমি খুজতে লাগলাম অন্য পন্থা। হঠাৎ মনে পড়ে গেল প্রবীন একজন ডাক্তারের কথা। যিনি দীর্ঘ দিন সৌদি আরবের নামকরা হাসপাতালে একজন সুচিকিৎসক রুপে ছিলেন কর্মব্যস্ত। তবে তিনি বর্তমানে পারালাইসিস রোগে নিজে আক্রান্ত। নিজ বাসায় বসে বসে রোগি দেখেন। তিনির ভিজিট ও মাত্র এক শত টাকা। নিয়ে গেলাম সেখানে। ডাক্তার সাহেব রোগিকে কিছু প্রশ্ন করলেন এবং বললেন আপনি এখনই সুস্থ হয়ে যাবেন কোন প্রকার পরিক্ষায় না পাঠিয়ে। লিখলেন মাত্র দুই শত টাকার ঔষধ। উপদেশ দিলেন আজ থেকে আপনি কোন প্রকার ঠান্ডা পানি ব্যবহার করবেন না। অজু গোসল ইত্যাদিতে ও। আর গরম কাপড চোপড করবেন পরিধান সর্বক্ষণ। আজ তিন বৎসর ঐ রোগি সম্পূর্ণ সুস্থ্য ভাবে চলাফেরা করছেন মহান রাববুল আলামিনের কৃপায়। পাঠক বলুনতো আমি আমরা কোথায় যাই এবং কি সিদ্ধান্ত নেই। এ ধরণের অনেক উদাহরণ আমার নিকট আছে যা কলেবর বৃদ্ধির শংকায় এখানেই সমাপ্ত করতে চাই। নতুবা আপনাদের ধৈর্যচ্যুতির কারন হয়ে দাড়াতে পারে বিবেচনায়। আবার আপনার অভয় বাণী শুনালে অন্যদিন অন্যত্র তা উপষÍাপন করার প্রত্যাশায় আজকের মত ইতি টানতে বাধ্য হলাম।
লেখক মিজানুর রহমান মিজান , সভাপতি বিশ্বনাথ প্রেসক্লাব সিলেট। মোবা ০১৭১২৮৭৯৫১৬।
দেখলাম যা দুই নয়নে ( ২য় পর্ব )
Sunday, October 6, 2013
Labels:
# সুরমা টাইমস
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
No comments:
Post a Comment