আব্দুল কুদ্দুস, কুলাউড়া
বৃহত্তর সিলেটের প্রাচীনতম কুলাউড়ার কাদিপুরের শিববাড়ীর মন্দিরটি পূজা অর্চনায় দেব-দেবীদের আরাধনায় দীর্ঘ ১৪২ বছরের কাল পরিক্রমায় হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের হৃদয়ের মণিকোঠায় আসীন করে নিয়েছে। নয়নাভিরাম নানা কারুকার্যময়ী শৈল্পিক আঁচড় আর চারপাশের নৈসর্গিক প্রাকৃতিক সৌন্দর্য মন কাড়ে আনন্দ-আবেগে। দেশের নানা প্রান্ত থেকে হিন্দু ধর্মের লোকজন
দূর্গাপূজা এলেই এখানে আসেন। দূর্গাপূজা ছাড়াও বছর জুড়ে ভক্তদের মানত আর ওখানে আসা-যাওয়ার দৃশ্য লক্ষ্যনীয়। বাঙালী হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব দূর্গাপূজায় এই ধর্মীয় উপাসনালয়ের গুরুত্বটাও পূজারিদের কাছে অন্যরকম। তাই হাজার হাজার ভক্তদের ভীড়ে মন্দিরটির পার্শ্ববর্তী কয়েক কিলোমিটার এলাকা লোকে-লোকারণ্য হয়ে উঠে। নবমীর দিন সকাল হতেই পুরোদিন দেবীর তুষ্টির জন্য প্রাপ্ত উপঢৌকন হিসেবে ভক্তদের কাছ থেকে আসা পশুপাখি (কবুতর, হাঁস, পাঁঠা, মহিষ) মন্দির সেবায়েতদের সংগ্রহের দৃশ্য নতুন আগত কাউকে অভিভূত করে। দূর-দূরান্ত থেকে পূণ্যার্থীরা ভোগ-নৈবদ্য, ফুল ও বিল্বপত্র নিয়ে পূজা অর্চনা করতে আসেন। প্রতি বছরের ন্যায় এবারও দূর্গাপূজার সব প্রস্তুতি চূড়ান্ত। এমনটিই জানালেন মন্দিরটির রক্ষনাবেক্ষন ও পূজা উদযাপন কমিটির সাথে সম্পৃক্তরা। এখানে দেবী দূর্গা ছাড়াও শিব মনসা, বালি, ভৈরব, শীতলা, চামুণ্ডা, শনিসহ দেব-দেবতার পূজা করা হয়। শিববাড়ীর ইতিহাস ঘেটে জানা যায়, এই বংশের কোন এক বংশধর তাদের দিঘির পাড়ে একটি বেলগাছের নিচে বসে নিয়মিত শিবের সাধনা করতেন। কিন্তু তখন কোন শিবলিঙ্গ এ বাড়িতে ছিল না। পরবর্তীতে পুলক সোমের তপস্যার ফসল হিসেবে ১৪০৮ সালে শিবলিঙ্গটি পাওয়া যায়। লিঙ্গটি পাওয়ার পর উপযুক্ত স্থান না থাকায় পুরোনো মন্দিরটি সংস্কার করে এই মন্দিরেই শিবলিঙ্গটি প্রতিষ্ঠা করা হয়। শিবলিঙ্গটি আবিস্কারের গল্প ক্রমেই প্রচার হতে থাকে। ক্রমশ অনেক ধর্মপ্রাণ ভক্তবৃন্দ সেখানে শিবলিঙ্গটি দর্শন করতে আসেন। শিলাটি প্রতিষ্ঠার পর প্রতিদিনই মন্দিরে চলতে থাকে পূজার্চ্চনা, ভোগ, আলতি, আরতি ইত্যাদি। ফুল, বিল্বপত্র, ভোগ, নৈবদ্য, ধূপ, দীপ ইত্যাদির মাধ্যমে নিয়মিত পূজা করা হয় এই মন্দিরে। উল্লেখ করা যেতে পারে, বড়বাড়ির লোকেরা ছিলেন জমিদার পরিবারের। তাদের পরিবারের এক সময় দোর্দণ্ডপ্রতাপশালী জমিদারী থাকলেও জমিদারী শাষণ উচ্ছেদের পর তাদেরকেও অন্যান্য জমিদার পরিবারগুলোর মত পড়তে হয় চরম আর্থিক দৈন্যতায়। ফলে পূর্বের বনেদী পূজা-অর্চনার আকাশ ছোঁয়া জৌলুস হ্রাস পেতে থাকে। তবে এর প্রভাবে তাদের ধর্মীয় বিশ্বাসে ঘাটতি পড়েনি একটুও। বিধি বিধান লঙ্ঘন না করে পূজা-পার্বন অব্যাহত ছিল এবং আগামীতেও থাকবে এমনটিই বিশ্বাস করেন অত্র অঞ্চলের সনাতন ধর্মাবলম্বীরা। অবশ্য গত প্রায় এক দশক থেকে মন্দিরটির পূর্বের জাঁকজমক ফিরে এসেছে। পূজার সময় ভক্তদের ভীড়ে মূখর হয়ে উঠে ঐতিহাসিক ও অনিন্দসুন্দর এ মন্দিরটি। এর স্থাপত্যশৈলী শুধু হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের নয় বরং মুগ্ধ করবে যে কোন ধর্মের রুচিশীল ব্যক্তিকেও। এই মন্দিরটির কথা শোনে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আসা পূণ্যার্র্থীদেরই অভিমত বৃহত্তর সিলেট বিভাগের মধ্যে কুলাউড়ার কাদিপুর ইউনিয়নের এই মন্দিরটিই সেরা।
No comments:
Post a Comment