এম এম মাসুদ |মানবজমিন:
একটি সিদ্ধান্তে বিপাকে বাংলাদেশ। অপার সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও পিছিয়ে পড়ছে দুবাইয়ের সঙ্গে যুক্ত ব্যবসায়ী ও সেখানে বসবাসরত বাংলাদেশীরা। ওয়ার্ল্ড এক্সপো-২০২০ যখন বিশ্বজুড়ে আলোচনায়। তখন আরব আমিরাতে বাংলাদেশীদের সব রকম ভিসা বন্ধ। অনেক ব্যবসায়ী তাদের ব্যবসায়িক প্রয়োজনেও দুবাইয়ের ভিসা পাচ্ছেন না। মাসের পর মাস তারা হচ্ছেন হয়রানির শিকার। অন্যদিকে এ সমস্যা সমাধানে সরকারের কোন উদ্যোগ চোখে পড়ছে না। দুবাই ফেরত ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে নানা হয়রানির চিত্র।
আগামী ২০২০ সালে সংযুক্ত আরব আমিরাতে (ইউএই) অনুষ্ঠেয় বিশ্ব রপ্তানি মেলা ওয়ার্ল্ড এক্সপো’র বিশাল সুবিধা ও অপার সম্ভাবনা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে বাংলাদেশ। একই সঙ্গে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনেও মারাত্মক ক্ষতির মুখোমুখি বাংলাদেশ। সংশ্লিষ্টরা
বলেছেন, দুবাইয়ের বন্ধ দরজা খুলতে সরকারকে এখনই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। ওয়ার্ল্ড এক্সপো দুবাইয়ে বিশাল কাজের ক্ষেত্র তৈরি করেছে। কিন্তু ভিসা বন্ধ থাকায় বাংলাদেশে বিপুল অর্থনৈতিক সম্ভাবনা থেকে পিছিয়ে পড়ছে। জানা গেছে, বাংলাদেশের জন্য বন্ধ থাকা শ্রমবাজার পুনরায় খোলাসহ দ্বিপক্ষীয় ও বহুপক্ষীয় সম্পর্কের স্বার্থে আরব আমিরাতের পক্ষে ভোট দেয়ার নীতিগত সিদ্ধান্ত ছিল। দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে টেলিফোন করে আনুষ্ঠানিক সমর্থনও চেয়েছিলেন। কিন্তু হঠাৎ করেই রাশিয়ার প্রতি সমর্থন দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। রাতারাতি চিত্র বদলে যায়। বাংলাদেশ প্রশ্নে কঠোর হয় দুবাই কর্তৃপক্ষ। ফলে বাংলাদেশী নাগরিকদের জন্য পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায় ইউএই’র ভিসা। দুবাইতে প্রায় ২৩ লাখ বাংলাদেশী রয়েছেন। সৌদি আরবের পর সবচেয়ে বেশি বাংলাদেশী আছেন রেমিট্যান্স আয়ের দ্বিতীয় বৃহত্তম উৎস দুবাইতে। সেখানে শ্রমজীবীসহ বিভিন্ন পেশায় কর্মরত মানুষের সংখ্যা বেশি হলেও অনেক বাংলাদেশীর নিজস্ব ব্যবসাও রয়েছে। কর্মসংস্থান বা এমপ্লয়মেন্ট ভিসা, ট্যুরিস্ট বা ভ্রমণ ভিসা এবং সব ধরনের বাণিজ্যিক ভিসা প্রদান সম্পূর্ণরূপে বন্ধ রেখেছে দেশটি। এ ছাড়া বাংলাদেশের সঙ্গে নিজেদের বাণিজ্যিক সম্পৃক্তিকে নানাভাবে গুটিয়ে নিতে শুরু করে মধ্যপ্রাচ্যের প্রভাবশালী এ দেশ। এ কারণে দেশটির সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্যিক কর্মকা- যেমন মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, তেমনি বিড়ম্বনার শিকার হচ্ছেন দুবাই হয়ে বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে ভ্রমণকারী বাংলাদেশী নাগরিকরা। এ ছাড়া কর্মসংস্থানের ব্যাপক সুযোগ থাকা এ দেশের দরজা এখন বাংলাদেশী শ্রমিকদের জন্য একেবারেই বন্ধ।
এদিকে দুবাইয়ে অনুষ্ঠিতব্য ‘ওয়ার্ল্ড এক্সপো-২০২০’-এর বিশাল আয়োজনে কর্মী নিয়োগে সরকারের পরিকল্পনা কিংবা প্রস্তুতির কোন নমুনা দৃশ্যমান নয়। এ ছাড়া আরও কয়েকটি দেশে জনশক্তি রপ্তানির ব্যাপক সুযোগ থাকা সত্ত্বেও প্রয়োজনীয় উদ্যোগের অভাবে তা অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।
ভোট দেয়ার বিনিময়ে শ্রমিক নেবে আরব আমিরাত এমন আগাম আভাসও পেয়েছিল বাংলাদেশ। পররাষ্ট্র দপ্তর এবং আমিরাতের বাংলাদেশ দূতাবাসে নিযুক্ত কূটনীতিকরাও সে পথেই হাঁটছিলেন। কিন্তু কাঙিক্ষত ভোটটি সংযুক্ত আরব আমিরাতকে না দেয়ার সিদ্ধান্তে সম্ভাবনা নষ্ট হতে চলেছে। হাতছাড়া হতে চলেছে বিরাট এই শ্রমবাজার।
সংশ্লিষ্টরা জানান, সামগ্রিক প্রেক্ষাপট ও দীর্ঘমেয়াদে দেশের স্বার্থ বিবেচনা না করে হুটহাট সিদ্ধান্ত যে সমস্যা তৈরি করে, তার সামপ্রতিক দৃষ্টান্ত ‘ওয়ার্ল্ড এক্সপো-২০২০’। কারণ জনশক্তি রপ্তানি তো বটেই, বাণিজ্য ও বিনিয়োগের নিরিখে মধ্যপ্রাচ্যের দেশ সংযুক্ত আরব আমিরাতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কটা বেশ নিবিড়। অথচ সরকারের উচ্চপর্যায়ের নির্দেশনায় রাশিয়াকে সমর্থন দেয়া হয়েছে।
মানব সম্পদ রপ্তানি তথ্যে দেখা যায়, ২০০৮ সালেও বাংলাদেশ থেকে সউদি আরবে ১ লাখ ৩২ হাজার ১২৪ কর্মী পাঠানো হয়েছে। তারপর ২০০৯ সালে তা কমে দাঁড়িয়েছে ১৪ হাজার ৬৬৬ জনে। সেই থেকে প্রতি বছর ধারাবাহিকভাবে সে দেশে কমসংখ্যক কর্মী গেছেন। ২০১০ সালে সউদি আরবে গেছেন মাত্র ৭ হাজার ৬৯, ২০১১ সালে ১৫ হাজার ৩৯, ২০১২ সালে ২১ হাজার ২৩২ এবং চলতি বছরের অক্টোবর পর্যন্ত সউদি গেছেন ১২ হাজার ৪০ জন। প্রায় একই অবস্থা বিদেশে বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম শ্রমবাজার সংযুক্ত আরব আমিরাতেও। গত বছর ২ লাখ ১৫ হাজার ৪৫২ কর্মী সংযুক্ত আরব আমিরাতে গেছেন। কিন্তু চলতি বছরে বাজারটির পতন ঘটেছে। সে দেশে চলতি বছরের অক্টোবর নাগাদ কর্মী গেছেন মাত্র ১১ হাজার ১১৩ জন। সহসাই সংযুক্ত আরব আমিরাতের বাজার খোলার কোন সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না।
এ বিষয়ে ব্যবসায়ীরা জানান, দুুুবাই সরকারের সঙ্গে দ্রুত আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে এ দূর অবস্থার অবসান দরকার। অর্থাৎ গভীর মনোযোগ দিতে হবে। ব্যবসায়ীদের মতে, ওয়ার্ল্ড এক্সপো দুবাইয়ে বিশাল কাজে ক্ষেত্র তৈরি করেছে। এজন্য বিশ্বের বিভিন্ন দেশ দুবাই সরকারের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক রক্ষা করে চলছে। তাদের মন্ত্রীরা দেশের বিভিন্ন সুবিধা নেয়ার জন্য নিয়মিত বৈঠকসহ নানা উদ্যোগ নিচ্ছে। সেখানে আমাদের সরকারের কোন তৎপরতা নেই।
উল্লেখ্য, বিশ্ব রপ্তানি মেলা-২০২০ আয়োজনে রাশিয়া, ব্রাজিল ও তুরস্ককে পেছনে ফেলে দুবাই জয়ী হয়েছে। ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে অনুষ্ঠিত ভোটে দুবাই জয়ী হয়। প্যারিসে ব্যুরো ইন্টারন্যাশনাল দেশ এক্সপোজিশন এর কার্যালয়ে ১৬৮ দেশের মধ্যে ভোটাভুটি অনুষ্ঠিত হয়। চূড়ান্ত পর্বে রাশিয়ার একাতেরিনবাগকে হারিয়ে আয়োজক হওয়ার গৌরব অর্জন করে আরব আমিরাতের শহর দুবাই। আরব আমিরাতের এই নগর তৃতীয় পর্বে ১১৬ ভোট পায়। অন্যদিকে একাতেরিনবাগ পায় মাত্র ৪৭ ভোট। ওয়ার্ল্ড এক্সপো ২০২০ উপলক্ষে ২০১৫ সাল থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত ২৩ বিলিয়ন ডলার আয় হবে। আর এ মেলার আয়োজনে ব্যয় হবে সাড়ে ৮ বিলিয়ন ডলার।
No comments:
Post a Comment