ওয়েছ খছরু,মানবজমিন: অর্থমন্ত্রীকে নিয়ে অস্বস্তিতে সিলেটের আওয়ামী লীগ। তার ওপর ক্ষোভ বাড়ছে নেতাদের। ৫ বছর নীরবে অনেক সয়ে যাওয়ার পর এবার অর্থমন্ত্রীর রোষানলে পড়া সিলেটের নেতারা মন্ত্রীকে নিয়ে নতুন করে অস্বস্তিতে পড়েছেন। তারা না পারছেন সইতে, না পারছেন বলতে- এমন অবস্থা এখন নেতাকর্মীদের মনে। ৫ বছরে তারা মন্ত্রীর কাছে যেটুকু আশা করেছিলেন সেটুকুই তো পাননি, এখন বরং দুর্নাম নিয়ে ঘুরে বেড়াতে হচ্ছে দলের নেতাকর্মীদের। অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বর্তমানে আমেরিকা সফরে আছেন। এ সফরেই তিনি বলেছেন, ‘সিলেটের আওয়ামী লীগ নেতারা জামায়াত নির্ভর হয়ে চলেন।’ তার এ বক্তব্যে ক্ষুব্ধ সিলেট আওয়ামী লীগ নেতারা। স্বচ্ছ ধারার রাজনীতিবিদ হিসেবে সিলেটবাসী আবুল মাল আবদুল মুহিতকে মর্যাদাপূর্ণ-১ আসনে ভোট দিয়ে জয়ী করেন। সিলেটের উন্নয়নে তিনি হাল ধরবেন এমন প্রত্যাশা নিয়ে তাকে নির্বাচিত করা হয়েছিল। কিন্তু ফল হয়েছে উল্টো। আবুল মাল আবদুল মুহিত নির্বাচিত হওয়ার পর তাকে অর্থমন্ত্রী করা হলেও তিনি সিলেটের উন্নয়নে দ্রুত পদক্ষেপ নেননি। বরং নানা কাজে তিনি বিলম্ব শুরু করেন। এই ফাঁকে তিনি সিলেটে দলকে তার মনের মতো করে সাজাতে শুরু করেন। সিলেট জেলা ও মহানগর আওয়ামী লীগে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটিয়ে তার অনুসারীদের কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত করেন। একই সঙ্গে সিলেটের রাজনীতিসহ প্রশাসনিক কাজে তার অনুসারীদের সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য দিতে থাকেন। এতে সিলেট আওয়ামী লীগের ‘মেয়রগ্রুপ’ ও ‘মিসবাহ গ্রুপ’ বলে পরিচিত দু’টি গ্রুপই রাজনীতির দৌড়ে পিছিয়ে যায়। আর তার যাতনায় পিষ্ট হয়েছেন আওয়ামী লীগ নেতা ইফতেখার হোসেন শামীম। সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যাওয়ার আগে সিলেটের এই বর্ষীয়ান নেতাকে রাজনীতি থেকে অনেকটা নির্বাসনে পাঠানো হয়। এ নিয়ে টানা তিন বছর সিলেট আওয়ামী লীগের মধ্যে ক্ষোভ-বিক্ষোভের অন্ত ছিল না। কিন্তু মুরব্বি মনে করে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে কেউ অবস্থান নেননি। একই সঙ্গে মন্ত্রী হওয়ার পর থেকে তৃণমূলের সঙ্গে বেশ দূরত্ব সৃষ্টি হয় অর্থমন্ত্রীর। বিভিন্ন সময় তার বেফাঁস মন্তব্যেও ক্ষুব্ধ হন ভোটাররা। বিব্রত হন নেতারা। অর্থমন্ত্রী ক্ষমতা গ্রহণের পরপরই সিলেট উন্নয়নের নানা তাগিদ তাকে দলের ভেতর থেকে দেয়া হয়েছিল। দলের নেতারা জানিয়েছেন, অর্থমন্ত্রী মুহিতের কাছে বিগত সরকারের অর্থমন্ত্রীর উন্নয়নের চিত্র তুলে ধরে তার চেয়ে বেশি উন্নয়নের দাবি রাখা হয়েছিল। কিন্তু অর্থমন্ত্রী সিলেটের উন্নয়নের দিকে নজর দেননি। দলীয় নেতারা জানান, বরং অর্থমন্ত্রী বিভিন্ন সময় বলেছেন, সিলেটের উন্নয়নের প্রয়োজন নেই। যা করার সাইফুর রহমানই তো করে দিয়েছেন। একই সঙ্গে একটি প্রজেক্টে উন্নয়নের নামে তিনি টাকা ছাড় দিতে বিলম্ব করেন। এতে সরকারের দুই বছর অতিবাহিত হওয়ার পরই তিনি দৃশ্যমান উন্নয়ন শুরু করেন। বিরোধী দলের নেতারা তো সব সময় দাবি করে আসছেন, সিলেটে দৃশ্যমান কোন উন্নয়ন নেই। বিগত সরকারের রেখে যাওয়া উন্নয়নের ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে পারেননি অর্থমন্ত্রী। তবে, অর্থমন্ত্রী তার শাসনের তিন বছরের মাথায় এক সংবাদ সম্মেলনে তার উন্নয়নের ফিরিস্তি তুলে ধরেছেন। আর এই উন্নয়নে তিনি সিটি করপোরেশনের উন্নয়ন মিলিয়ে ২০০০ কোটি টাকার উন্নয়ন পরিসংখ্যান তুলে ধরেন। এই উন্নয়নের মধ্যে তিনি সিলেটের নতুন কারাগার স্থাপন, নগরীর কুশিঘাটে পানি শোধনাগার স্থাপন ও নগরীতে কয়েকটি কমিউনিটি ক্লিনিক স্থাপন ছাড়া দৃশ্যমান কোন উন্নয়ন তুলে ধরতে পারেননি। তবে, অর্থমন্ত্রীর উন্নয়নের ফিরিস্তিতে সাবেক মেয়র কামরানের উন্নয়নের ফিরিস্তি তুলে ধরায় তুমুল বিতর্ক দেখা দেয়। তৎকালীন মেয়র কামরান জানিয়েছিলেন, তিনি সিলেট নগরীতে ৫০০ কোটি টাকার উন্নয়ন ঘটিয়েছেন। আর উন্নয়নের বেশির ভাগ টাকা তিনি নিজ উদ্যোগে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে ধর্না দিয়ে নিয়ে এসেছেন। অর্থমন্ত্রী টাকা ছাড় দেয়ায় তিনি ওই উন্নয়নকে তার নিজের উন্নয়ন বলে চালিয়ে নেন। এ নিয়ে সাবেক মেয়র কামরানের সঙ্গে অর্থমন্ত্রীর মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্বও ছিল। কিন্তু দলের স্বার্থে কেউ-ই দ্বন্দ্বের মাত্রা বাড়াননি। সিলেটের এমসি কলেজের ছাত্রাবাস পোড়ানো, নগরীতে স্বর্ণের দোকানি ডাকাতির ঘটনায় সিলেটে বিতর্কিত হন অর্থমন্ত্রী নিজেও। তিনি প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা না নেয়ায় সাধারণ মানুষ তার ওপর ক্ষুব্ধ। অর্থমন্ত্রী মন্ত্রী হওয়ায় বিগত সিটি নির্বাচনে মেয়রপ্রার্থী কামরানের পক্ষে প্রকাশ্যে আসেননি। তার গ্রুপের নেতারাও কামরানের ওপর অনেকটা অভিমানী ছিলেন। তবে, সিনিয়র নেতাদের হস্তক্ষেপে তাদের মধ্যে সম্পর্কের উন্নয়ন হলেও নির্বাচনের আগের দিন সিলেটে অর্থমন্ত্রীর সফর কামরানের নির্বাচনে বেশ প্রভাব ফেলেছে মনে করেন দলীয় নেতারা। ১৪ই জুন অর্থমন্ত্রী সিলেটে এসে নেতাকর্মীদের নিয়ে শহরে ঘুরে বেড়িয়েছেন। এতে কামরানের ভোটে মন্ত্রীর দাপটের প্রভাব পড়ছে বলে দলের ভেতর থেকেই অভিযোগ করা হয়। তবে, অর্থমন্ত্রী নিজে ভোট দিয়ে ঢাকায় চলে গেছেন। আর নির্বাচনের পর থেকে সিলেটের আওয়ামী লীগের মধ্যে দ্বন্দ্ব, রেষারেষি চলছে। দলের নেতারা জানান, বিগত সিটি নির্বাচনে আওয়ামী লীগের তৃণমূল কাজ করেনি। এ কারণে কামরানের পরাজয় হয়েছে। এ কারণে নির্বাচনের পর থেকে কামরান ক্ষুব্ধ রয়েছেন অর্থমন্ত্রীর ওপর। এদিকে, সিটি নির্বাচনের পর থেকে একই ভাবে দূরত্ব বেড়েছে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক এডভোকেট মিসবাহ উদ্দিন সিরাজেরও। আর নির্বাচনের পর বিরোধী জোটের মেয়র আরিফুল হক চৌধুরীর সঙ্গে মন্ত্রীর ঘনিষ্ঠতাকেও ভালভাবে মেনে নিচ্ছেন না দলের নেতারা। এদিকে, গত সপ্তাহে আমেরিকায় এক অনুষ্ঠানে অর্থমন্ত্রী জামায়াত-প্রীতির দায় চাপিয়েছেন সিলেটের আওয়ামী লীগের ওপর। এ ব্যাপারে সাবেক মেয়র ও মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি বদরউদ্দিন আহমদ কামরান জানিয়েছেন, জামায়াতের সঙ্গে সিলেটের আওয়ামী লীগের সম্পর্ক কোনভাবে ঠিক নয়। তিনি বিশ্বাস করেন অর্থমন্ত্রী এরকম কথা বলতে পারেন না। তার বক্তব্য হয়তো ভিন্নভাবে উপস্থাপন করা হতে পারে। এদিকে, সিলেটে টি-টুয়েন্টি বিশ্বকাপের ভেন্যু বিভাগীয় স্টেডিয়ামে ৮৭ কোটি টাকার কাজ শেষ সময়ে ছাড় দেন অর্থমন্ত্রী। এই টাকাটা আরও ৪ মাস আগে ছাড় দিলে এতদিন মাঠ পুরোপুরি প্রস্তুত থাকতো বলে জানিয়েছেন ক্রীড়ামোদীরা। বিলম্বে টাকা পাওয়ার কারণে এখনও চূড়ান্ত হয়নি সিলেটের টি-টুয়েন্টি বিশ্বকাপের ভেন্যুর সিদ্ধান্ত।
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
No comments:
Post a Comment