মানবজমিন: ভারতের সঙ্গে সমুদ্রসীমা নির্ধারণে বাংলাদেশ ৬০০০ বর্গকিলোমিটার সীমা হারিয়েছে বলে অভিযোগ করেছে বিএনপি। দলটি দাবি করেছে, বাংলাদেশ যে ১৯ হাজার বর্গ কিলোমিটার সমুদ্রসীমা পেয়েছে সেটা বিরোধপূর্ণ ছিল না। বাংলাদেশের বৈধ সম্পত্তিই ছিল। এই রায়ের মাধ্যমে বাংলাদেশ দক্ষিণ তালপট্টিসহ ৬০০০ বর্গ কিলোমিটার সীমা হারিয়েছে। এতে বঙ্গোপসাগরে ভারতের নিরঙ্কুশ একক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা হয়েছে। সরকারের কাছে স্বচ্ছভাবে রায়ের বিস্তারিত ব্যাখ্যাও দাবি করেছে দলটি। গতকাল বিএনপি চেয়ারপারসনের গুলশানের রাজনৈতিক কার্যালয়ে আন্তর্জাতিক সালিশ আদালতের ঘোষিত রায়ের আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া জানাতে এক সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে বিএনপি। এতে বিএনপির দুই ভাইস চেয়ারম্যান মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমেদ বীরবিক্রম, শমসের মবিন চৌধুরী, চেয়ারপারসনের দুই উপদেষ্টা ইনাম আহমেদ চৌধুরী ও রিয়াজ রহমান রায়ের বিভিন্ন অসঙ্গতির ব্যাপারে পুঙ্খানুপুঙ্খ যুক্তি তুলে ধরেন। গত ৮ই জুলাই ভারতের সঙ্গে সমুদ্রসীমা নির্ধারণে আন্তর্জাতিক সালিশি আদালতের রায় প্রকাশ করেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী। রায় অনুযায়ী বঙ্গোপসাগরের বিরোধপূর্ণ সাড়ে ২৫ হাজার কিলোমিটার এলাকার মধ্যে প্রায় সাড়ে ১৯ হাজার কিলোমিটার এলাকা বাংলাদেশ পেয়েছে। আন্তর্জাতিক সালিশ আদালতের রায়ের বিস্তারিত ব্যাখ্যা দিয়ে সাবেক পানিসম্পদ মন্ত্রী মেজর (অব.) হাফিজ বলেন, সরকার সমুদ্র বিজয়ের যে কথা বলেছে, তা ঠিক নয়। এই রায়কে সরকার রাজনৈতিক রঙ দিচ্ছে। মিয়ানমারের সঙ্গে সীমানা নির্ধারণেও তারা একই রকম কথা বলেছিল। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেছে, ওই সময়ে আমরা কয়েকটি গ্যাস-তেল ব্লক হারিয়েছি। এবারও ভারতের সঙ্গে সমুদ্র সীমানা নির্ধারণের ১০টি ব্লক পাওয়ার যে কথা বলা হচ্ছে- আমরা এ ব্যাপারে তথ্য-উপাত্ত সহকারে সরকারের বিস্তারিত ব্যাখ্যা দাবি করছি। দক্ষিণ তালপট্টি দ্বীপের বিষয়ে সাবেক এই পানি সম্পদমন্ত্রী বলেন, এই দ্বীপটি বাংলাদেশের অবিচ্ছেদ্য অংশ। জিয়াউর রহমানের শাসনামলে এই দ্বীপটির মালিকানার দাবি তোলা হয়। জিয়াউর রহমান এই দ্বীপের মালিকানার বিষয়টি আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিলেন। ওই সময়ে ভারতও এই দ্বীপের দাবি জানিয়েছিল। এই নিয়ে দুই দেশের যুদ্ধ জাহাজও সেখানে গিয়েছিল। এই দ্বীপটির অধিকার ছেড়ে দেয়া উচিত হয়নি। তিনি বলেন, সালিশ আদালতের রায়ে আমাদের বড় পরাজয় ঘটেছে। বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের স্থলসীমা পুনর্নির্ধারণ করতে গিয়ে আমাদের সর্ব দক্ষিণ-পশ্চিম সীমানার প্রায় ৪ দশমিক ৫ কিলোমিটার পূর্ব দিকে সরে এসেছে। এতে বাংলাদেশ তার স্ট্র্যাটেজিক রাজনৈতিক গুরুত্বপূর্ণ দক্ষিণ তালপট্টি দ্বীপের ওপর অধিকার হারিয়ে ফেলেছে। সরকারের ব্যর্থতার পক্ষে যুক্তি তুলে ধরে মেজর (অব.) হাফিজ বলেন, বাংলাদেশ তার দক্ষিণ-পশ্চিম সীমানা রেফারেন্স হিসেবে তালপট্টি দ্বীপের দাবিটি সঠিকভাবেই উপস্থাপন করেছিল। এক্ষেত্রে তারা যে ম্যাপটি ব্যবহার করেছিল, তা ছিল ১৮৮০ থেকে ১৯০৪ সালের মধ্যে জরিপের ভিত্তিতে প্রণীত বৃটিশ এডমিরাল চার্ট। বাংলাদেশ একটি ভুল তথ্য দিয়েছিল যে, এটি ১৯৩৩ সালের তৈরি। এই ভুল তথ্যের কারণে এই ম্যাপটির বদলে ১৯৪৭ সালের কাছাকাছি সময়ের কোন মানচিত্র বা এরিয়াল ফটোগ্রাফ চাওয়া হয়েছিল। এটি বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ সরবারহ করতে ব্যর্থ হয়েছে। মেজর (অব.) হাফিজ বলেন, বাংলাদেশ চাইলে ১৯৫৫ সালের যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাহিনীর টপোমানচিত্র সরবরাহ করতে পারতো। যেখানে পরিষ্কারভাবে দেখানো আছে, র্যাডক্লিফের বিভাজন রেখা হাড়িয়াভাঙা নদীর মধ্যরেখায় অবস্থিত তালপট্টি হাড়িয়াভাঙা নদীর মোহনাতেই শেষ হয়েছে। হাড়িয়াভাঙা প্রবাহের চেয়ে রায়মঙ্গল নদীর প্রবাহ অনেক বেশি। তা সম্পূর্ণ বাংলাদেশের নদী। রায়মঙ্গল প্রবাহের সঙ্গে যমুনা নদীর প্রবাহ যোগ হয়েছে। তাই ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সীমানা কোনভাবে রায়মঙ্গলের মধ্যপ্রবাহ হতে পারে না। অথচ রায়ে মধ্যপ্রবাহ ধরা হয়েছে রায়মঙ্গলকে। এটি সঠিক নয়। আন্তর্জাতিক সালিশ আদালতে বাংলাদেশের পক্ষে অভিজ্ঞ আইনজ্ঞ এবং বিশেষজ্ঞদের নিয়োগ করা হয়নি অভিযোগ করে মেজর (অব.) হাফিজ বলেন, ভারতের পক্ষে সে দেশের বিচারক পিএস রাওকে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। অথচ আমাদের পক্ষে দেশের কোন বিচারক নয়, ঘানার নাগরিক বিচারক টমান ম্যানশাকে নিয়োগ দেয়া হয়। পিএস রাও ভারতের পক্ষে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। তিনি কয়েকটি ‘নোট অব ডিসেন্ট’ও দিয়েছেন। আর বাংলাদেশের পক্ষের বিচারক কোন ‘নোট অব ডিসেন্ট’ দেননি। কেবল তাই নয়, এই মামলায় ভারতের সমুদ্র বিশেষজ্ঞ ও এটর্নি জেনারেল অংশ নিয়েছেন। আর বাংলাদেশের পক্ষে এটর্নি জেনারেল অংশ নেননি। ড. কামাল হোসেনের মতো আন্তর্জাতিক আইনজ্ঞ এবং সাবেক সচিব কেএস মোর্শেদের মতো অভিজ্ঞ ব্যক্তিদের এই ট্রাইব্যুনালের কার্যক্রমে ব্যবহার করা হয়নি। ফলে আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি। খালেদা জিয়ার শাসনামলে সমুদ্রসীমা নির্ধারণে নেয়া পদক্ষেপের বিষয়টি তুলে ধরে মেজর (অব.) হাফিজ বলেন, বিএনপি জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়ে বেশ কয়েকবার দেশ চালিয়েছে। আমরা দুগ্ধপোষ্য নই যে, সমুদ্র সম্পদের গুরুত্ব উপলব্ধি করতে পারবো না। সুতরাং সমুদ্র বিজয়ের পর পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দেয়া বক্তব্য অসত্য। এর মাধ্যমে আগের সরকারগুলোকে খাটো করার চেষ্টা চালানো হয়েছে। বিএনপি সরকারের সময়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আলাদা মেরিটাইম সেল, দক্ষ জনবল নিয়োগ, একটি আলাদা ভবনসহ বিশেষজ্ঞদের যুক্তরাষ্ট্রে পাঠিয়ে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেছিল। ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেনের নেতৃত্বে একটি জাতীয় কমিটিও গঠন করা হয়েছিল- যাতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, পেট্রো বাংলা, নৌবাহিনী, জরিপ অধিদপ্তর, স্পার্সোসহ ৭টি প্রতিষ্ঠান যুক্ত ছিল। ওই সময়ে সমুদ্রের বিষয়ে কোন প্রকৃত তথ্য ছিল না। কেবল তাই নয়, ওই সময় সমুদ্রে জাহাজ নিয়ে জরিপও চালানো হয়েছিল। অথচ বর্তমান পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, ’৭৫-পরবর্তী সরকারগুলো এ বিষয়ে কোন কাজ করেনি। এটি সঠিক নয়। তিনি বলেন, আমরা মনে করি, এই রায়ে অনেক অসঙ্গতি রয়েছে। আমরা কতটুকু পেয়েছি বলা হলেও ভারত কতটুকু পেলো তা সরকার বলছে না। অনেক কিছুই দেশবাসী জানছে না। তিনি বলেন, সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে- এটি বাংলাদেশের জন্য বিজয়। পরক্ষণেই আবার শুনলাম, ভারতেরও নাকি বিজয় হয়েছে। আন্তর্জাতিক আদালতে দুই পক্ষের বিজয় হওয়া সম্ভব নয়। এটা জয় পরাজয়ের বিষয়ও নয়। এটি ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠার আন্তর্জাতিক প্রচেষ্টা মাত্র। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি ও বৈদেশিক কূটনীতি প্রতিবেশী দেশ নিয়ন্ত্রণ করছে অভিযোগ করে মেজর (অব.) হাফিজ বলেন, সে জন্য রায়ের বিষয়ে আমরা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাছে বিস্তারিত ব্যাখ্যা চাই। সরকারের কাছে দাবি থাকবে, বাগাড়ম্বর বাদ দিয়ে জাতীয় সম্পদ আহরণ ও রক্ষায় ঐকমত্যের ভিত্তিতে নীতিমালা প্রণয়ন করা হোক। এ বিষয়ে আমরা তাদের সর্বাত্মক সহযোগিতা করবো। এক্ষেত্রে বর্তমান সরকারের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে একটি জনপ্রতিনিধির সরকার প্রতিষ্ঠার প্রতি গুরুত্ব আরোপ করেন তিনি।
ভারত পেয়েছে বলেই সরকার বলছে তালপট্টির অস্তিত্ব নেই: শমসের
‘তালপট্টি দ্বীপের কোন অস্তিত্ব ছিল না এটি ম্যাপে নেই’- বলে সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনি ও রিয়ার এডমিরাল (অব.) খোরশেদ আলমের বক্তব্যের প্রতিবাদ জানিয়েছে বিএনপি। বিএনপির আরেক ভাইস চেয়ারম্যান শমসের মবিন চৌধুরী বলেন, তাদের দুইজনের বক্তব্য সঠিক নয়। দক্ষিণ তালপট্টি আছে, এটি ১৯৭৫ সালের ম্যাপই প্রমাণ করে। জিয়াউর রহমানের শাসনামলে এ সংক্রান্ত মানচিত্র প্রকাশ করা হয়েছিল। এখন ভারত পেয়েছে বলে সরকার বলছে এর কোন অস্তিত্ব নেই। রিয়ার এডমিরাল (অব.) খোরশেদ ওই সময়ে নৌবাহিনীতে কাজ করতেন। তিনি নৌবাহিনীর যুদ্ধ জাহাজ নিয়ে তালপট্টিতে অবস্থান নিয়েছিলেন। সেখানে একটি লাইট হাউজও স্থাপন করা হয়েছিল। এখন তিনি ভিন্ন কথা বলেছেন। শমসের মবিন বলেন, ২০০৯ সালের মে মাসে সরকার ইউএনসিএস বডিতে বঙ্গোপসাগরের মহীসোপানের নির্ধারণের দাবি জানিয়ে আবেদন করেছিল। ওই বিষয়টির নিষ্পত্তি না হওয়ার আগে আবেদন প্রত্যাহার করে ওই বছরের জুলাই মাসে সরকার হেগ-এ আরবিটেশন কাউন্সিলে যায়। এখন আন্তর্জাতিক আদালতের রায়ের পর আবার কেন আমরা ইউএনসিএস এ ফেরত যাচ্ছি। কারণ এই সালিশ আদালতের পর আপিলের কোন সুযোগ নেই।
সরকার দক্ষিণ তালপট্টির অধিকার হারিয়েছে: বিএনপি
Thursday, July 10, 2014
Labels:
# আমাদের সিলেট
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
No comments:
Post a Comment