তাওহীদ হত্যা মামলা নিয়ে সন্দেহ ঘনীভূত; সৌমেনের বক্তব্য সাজানো, গ্রেফতার ছিল নাটক : সন্দেহ আইনজীবীদের

Tuesday, June 10, 2014

আমাদের সিলেট ডটকম:

ওসমানী মেডিক্যাল কলেজ ছাত্রদল নেতা তাওহীদ হত্যা মামলা নিয়ে সন্দেহ ঘনীভূত হচ্ছে। একাধিক আইনজীবী সন্দেহ প্রকাশ করে বলেছেন, ১৬৪ ধারায় দেয়া সৌমেনের জবানবন্দিতে কৌশলে সে নিজেকে রক্ষার চেষ্টা করেছে। তারা এ ও সন্দেহ করেছেন, ঘটনার রাত থেকেই পুলিশ হেফাজতে ছিল কলেজ ছাত্রলীগ সভাপতি সৌমেন। পরবর্তীতে তাকে নাটকীয় কায়দায় গ্রেফতার দেখিয়ে সুকৌশলে নির্দেশনা দিয়ে একটি সাজানো বক্তব্য উপস্থাপন করা হয়েছে আদালতে। এই বক্তব্যের মাধ্যমে সৌমেন ও তার সহযোগী ছাত্রলীগ সন্ত্রাসীদের বাঁচানোর চেষ্টা চলছে অভিযোগ তুলেছেন আইনজীবীরা।

আমাদের সিলেট ডটকম-কে দেয়া বক্তব্যে এ সব সন্দেহের কথা ব্যক্ত করেছে জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের সদস্য এডভোকেট হাসান আহমদ পাটোয়ারী রিপন। তিনি বলেছেন, আমরা নিশ্চিত ঘটনার পর গত ৪ জুন রাতেই কলেজ ছাত্রলীগ সভাপতি সৌমেন দে কে নিজেদের হেফাজতে নিয়েছিল পুলিশ। এর দুদিন পর নাটক সাজিয়ে তাকে সিলেট রেলস্টেশন থেকে গ্রেফতার দেখানো হয়। ঐ দুদিনে বোঝাপড়া হয় নানা মহলে। কিভাবে সন্ত্রাসীদের বাঁচানো হবে- তার রূপরেখা প্রণয়ন করা হয়। এরপর নির্দেশনা দেয়া হয় সৌমেন কি বক্তব্য দেবে ১৬৪ ধারার জবানবন্দিতে। সে অনুযায়ীই আদালতে জবানবন্দি দেয় সৌমেন।

এডভোকেট রিপন বলেন, ১৬৪ ধারায় দেয়া ঐ জবানবন্দিতে যে সব তথ্য সৌমেন উপস্থাপন করেছে তাতে নিজেকে খুবই কৌশলে বাঁচানোর চেষ্টা করেছে সৌমেন। সে নিজেকে ঘটনার সাথে নিরাপদ দূরত্বে রেখেছে। আর অন্যদেরও বাঁচিয়েছে সাজানো বক্তব্যের মাধ্যমে। কলেজ প্রিন্সিপাল ও হোস্টেল তত্বাবধায়কের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্নের উদ্রেক হয়েছে তার বক্তব্য থেকে। এছাড়া, ঘটনার পর পরই বিএনপি ও ছাত্রদলের পৰ থেকে হোস্টেলে তল্লাশীর দাবী তোলা হলেও প্রশাসন তাতে কর্ণপাত করেনি। ফলে, আসামীরা হত্যার আলামত নষ্ট করার ও নিরাপদে পালিয়ে পালিয়ে যাবার সুযোগ পেয়েছে।

ঐ আইনজীবী দাবী করেন, কলেজ অধ্যক্ষ ও হোস্টেল তত্বাবধায়কের উপস্থিতিতে হত্যাকান্ড ঘটেছে বলে স্বীকার করেছে সৌমেন। তাহলে এই মামলাতে এ দুজনকেও আসামী করা একান্ত প্রয়োজন। অথচ, মামলাতে তাদের সাক্ষীও করা হয়নি। এ সব বিষয়ে জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের সিনিয়র আইনজীবীরা পর্যালোচনা করছেন এবং এই বিষয়ে আইনি পদক্ষেপ নেয়ার চেষ্টা করছেন।


সৌমেনের জবানবন্দিতে যা আছে :

ছাত্রদল নেতা তাওহীদ হত্যাকান্ডে আটক কলেজ ছাত্রলীগ সভাপতি সৌমেনের দেয়া ১৬৪ ধারার জবানবন্দি পড়ে হত্যাকান্ডের রোমহর্ষক বর্ণনায় শিউরে উঠতে হবে সবাইকেই।

গত রোববার সিলেটের জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট সাহেদুল করিমের কাছে দেয়া এই জবানবন্দিতে সৌমেন জানিয়েছে কথামত দেড় লাখ টাকা চাঁদা পরিশোধ না করায় পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে তাওহীদকে। আর ক্রিকেট স্ট্যাম্প ও জিআই পাইপের একের পর এক আঘাতে যখন নিথর হয়ে পড়ে তাওহীদ তখন ঐ নিথর দেহের পাশেই খোশগল্পে মেতে উঠেছিল হত্যাকান্ডে অংশ নেয়া ১৫ সদস্যের কিলার গ্রুপ।

১৬৪ ধারার জবানবন্দিতে কলেজ ছাত্রলীগ সভাপতি সৌমেন দে জানায়, বর্তমানে ইন্টার্নশিপ করছে সে। সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতি ডা: সৌমেন দে ঘটনার দিন মর্নিং শিফটে বিকেল ৩টা পর্যন্ত ডিউটি করে নে। এরপর হোস্টেলে এসে ঘুমিয়ে পড়ে। বিকেল সাড়ে ৫টায় ঘুম থেকে জেগে উঠে নাস্তা করতে যায়। ৫টা ৫০ মিনিটে নাস্তা সেরে রুমে যাওয়ার ৫ মিনিট পর মেডিকেল কলেজ ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক মো: সাইফুল হাই ফোনে জানায়, ছাত্রদলের আপ্যায়ন বিষয়ক সম্পাদক তৌহিদুল ইসলামের অবস্থা খুবই খারাপ। ফোনে একথা শোনার পর সিনিয়র ইন্টার্ন ডা: তাহলিল হোসেন শাওন ও সহপাঠী ডা: আসাদকে সাথে নিয়ে আবু সিনা ছাত্রাবাসে যায় ডা: সৌমেন দে। সেখানে হল সুপার ডা: আবু ইউসুফ ভূইঞা এ সময় ছিলেন। আবু সিনা ছাত্রাবাসের ১০০৩ নং র্বমে ঢুকে সৌমেন দেখতে পায়, তৌহিদুল ইসলামের দেহ রক্তাক্ত অবস্থায় মেঝেতে পড়ে রয়েছে। এ সময় তৌহিদ অজ্ঞান ছিল। রুমের ভেতরে তখন কলেজের ৪৯ ব্যাচের (৪র্থ বর্ষ) রাফি, রিপন, অন্তর দীপ, হাফিজ ফারহান আনজুম নিশাত পাঠান, আশিষ, ৪৮ ব্যাচের (৫ম বর্ষ) সাইফুল ইসলাম (সাধারণ সম্পাদক) ও শরীফকে দেখতে পান।

সৌমেন বলেন, এ সময় স্যার (হল সুপার) তৌহিদের অবস্থা নিয়ে শংকা প্রকাশ করেন। জবানবন্দীতে ডা: সৌমেন দে আরো বলেন, প্রিন্সিপাল স্যারকে (ডা: মুর্শেদ আহমদ চৌধুরী) ফোন করলে তিনি দ্র্বত তৌহিদকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে বললে এ্যাম্বুলেন্স নিয়ে ৬টা ১০ মিনিটে ঘটনাস্থলে পৌঁছেন। ততক্ষণে প্রিন্সিপাল ও কয়েকজন হোস্টেল গার্ড সেখানে উপস্থিত হয়ে যান। ধরাধরি করে তৌহিদকে এম্বুলেন্সে উঠানো হয়। ডা: সৌমেন ও শরীফুল সামনে, রাফি, পাঠান, অমত্মরদীপ, হাফিজ, আশিষ ও ফাহিম এ্যাম্বুলেন্সের ভেতরে বসেন। হাসপাতালে নেয়ার পর তৌহিদকে আই সি ইউতে নেয়া হয়। এরপর সৌমেন হোস্টেলের দিকে চলে যায়। ১০০৩ নং র্বমে এ সময় ৪৯ ব্যাচের ফাহিম ও ছিলেন।

স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দীতে মেডিকেল কলেজ ছাত্রলীগ সভাপতি সৌমেন দে বলে, ২য় পেশাগত পরীৰা দেয়ার জন্যে রাফি ও পূর্বে উলেৱখিত ৪৯ ব্যাচের বাকীর মিলে তৌহিদের কাছে ২ লাখ টাকা চাঁদা দাবী করে। ৫০ হাজার টাকা পরিশোধ করে তাওহীদ। বাকী টাকার জন্যে তৌহিদকে ৩টার দিকে আবু সিনায় ডেকে আনা হয়। আবু সিনার ১০০৩ নং র্বমে তৌহিদ আসলে রাফি, রিপন, অন্তরদীপ, হাফিজ, নিশাত পাঠান, ফাহিম, আশিষ ও জুবায়ের তাকে (তৌহিদ) স্ট্যাম্প ও জি আই পাইপ দিয়ে মারধর করে। এরপর রাফি, ৫০ ব্যাচ ৩য় বর্ষ এর টুটুল, জিনান, তানজিদ, আবজাল, মামুনদের ফোনে ডেকে আনে। তারা এসে বেধড়ক মারধর করে তৌহিদকে। এরপর ৫টার দিকে রাফি সাইফুলকে ফোন করে বলে, ‘ধরেছি আপনারা আসেন।’ পরে সাইফুল ও শরীফুল ( কলেজের ছাত্রলীগ নিয়ন্ত্রিত সাংস্কৃতিক সংগঠন অঙ্গীকার সম্পাদক) ঘটনাস’লে যান। তখনো তৌহিদের জ্ঞান ছিল। ৪৯ ও ৫০ ব্যাচের ছেলেরা বসে এ র্বমেই খোশ গল্পে মেতে উঠে।

জবানবন্দিতে তিনি আরো বলেন, এসব ঘটনার পর বন্ধু মনজুর মোর্শেদ আলীম (১০৬ নং র্বম), আব্দুল্লাহ আল শিবলী (১০৭ নং রম্নম), নিবরাম আহমদ চৌধুরীসহ (২০৫ নং র্বম) মিরাবাজারস্থ নানীর বাসায় চলে যান। সকলের মোবাইল ফোন বন্ধ পান। ৫ জুন রাতে অন্য একটি নম্বর থেকে সাইফুল ফোন করে জানায়, সে ও শরীফুল ঢাকায় চলে গেছে। তিনি নিজেও ঢাকায় যাওয়ার সময় পুলিশের হাতে গ্রেফতার হন। ডা: সৌমেন দে চাঁদপুর জেলার নিতাইগঞ্জের দিলীপ কুমার দের পুত্র। পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, সহপাঠীদের হাতে গত ৪ জুন বিকেলে ওসমানী মেডিকেল কলেজের ৪৯ ব্যাচের ৪র্থ বষের্র ছাত্র ও কলেজ ছাত্রদলের আপ্যায়ন বিষয়ক সম্পাদক তৌহিদুল ইসলাম নিহত হন। নিহত তৌহিদ শরীয়তপুর জেলার জাজিরা থানার বড়গোপালপুরের পাচু মাতবরকান্দির শামসুর রহমান আজু মাতবরের পুত্র। ৩ বোন ও একপুত্র সন্তানের মধ্যে তিনি ছিলেন ৩য়।স্থানীয় জাজিরা মহর আলী পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি ও ঢাকা কলেজ থেকে এইচএসসি পাশের পর মানবতার সেবক চিকিৎসক হওয়ার প্রত্যাশায় ভর্তি হন ওসমানী মেডিকেল কলেজে। নিজে ছাত্রদলের সাথে সম্পৃক্ত হলেও তৌহিদের পরিবার আওয়ামীলীগের রাজনীতির সাথে জড়িত। তার পিতা স্থানীয় বড়গোপালপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও ইউনিয়ন আওয়ামীলীগের সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন। ঘটনার পর নিহতের চাচা আওয়ামী লীগ নেতা আনোয়ার হোসেন মাতবর বাদী হয়ে ৫ জুন কোতোয়ালী থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। মামলা নং ৪। মামলায় মেডিকেল কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতি সৌমেন দে, সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হাই, সাংগঠনিক সম্পাদক রাফিসহ ১০ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাতনামা ১০ জনকে আসামী করা হয়। মামলা দায়েরের পর এজাহারভূক্ত ১০ আসামীকে সাময়িকভাবে বহিষ্কার করে কলেজ কর্তৃপৰ।

এদিকে ঘটনার ৬ দিনের মধ্যে কেবলমাত্র এক আসামীকে গ্রেফতার করা সম্ভব হলেও অন্যদের কোনো হদিস পাচ্ছেনা পুলিশ। এমনকি মামলার ব্যাপারে তদন্ত কর্মকর্তার সাথে জানতে চেয়ে যোগাযোগ করা হলে তিনি কোনো তথ্য দিতে চাননি। অবশ্য পুলিশের একটি সূত্র বলেছে, আসামীদের গ্রেফতারের লৰ্যে সিলেট ও সিলেটের বাইরে পুলিশের অভিযান অব্যাহত রয়েছে। তদন্তকারী কর্মকর্তা কোতোয়ালী থানার এসআই সিরাজুল ইসলাম ও একই কথা বলেছেন।





Share on :

No comments:

Post a Comment

 
Copyright © 2015. Sylhet News.
Design by Herdiansyah Hamzah. Published by Themes Paper. Distributed By Kaizen Template Powered by Blogger.
Creative Commons License