আমাদের সিলেট ডটকম : মুন্সীগঞ্জের মাওয়া ঘাটের কাছে পদ্মায় ডুবে যাওয়ার পর তিনদিন পেরিয়ে গেলেও পিনাক-৬ লঞ্চটির অবস্থান চিহ্নিত করা যায়নি।
এদিকে, পদ্মা নদীর ভাটিতে ও মেঘনার বিভিন্ন স্থানে ভেসে উঠছে লাশ। বুধবার ভোলা সদর ও চাঁদপুরের হাইমচরের মেঘনা এবং শরিয়তপুরে পদ্মা নদীতে ভেসে উঠেছে পাঁচটি লাশ, যার মধ্যে দুই জনের পরিচয় জানা গেছে। বাকি লাশগুলোও ডুবে যাওয়া লঞ্চ পিনাক-৬ এর যাত্রীদের বলে স’ানীয় পুলিশের ধারণা।
এছাড়া শরিয়তপুরের নড়িয়ার সুরেশ্বর-ওয়াপদা এলাকা এবং জাজিরার কুণ্ডের চরে আরো পাঁচটি লাশের খবর পাওয়া গেলেও স্থানীয় প্রশাসন বিষয়টি নিশ্চিত করতে পারেনি।
এদিকে দুর্ঘটনাস’লের কাছ থেকে এক মহিলার লাশ উদ্ধার করা হয়েছে।
এর আগে মঙ্গলবার চাঁদপুরে মেঘনায় দুটি লাশ পাওয়া যায়, যার মধ্যে একটি সনাক্তের জন্য মাদারীপুরে পাঠিয়েছে স’ানীয় প্রশাসন।
বুধবার সকাল থেকে ভোলা সদরের রাজাপুর ও কাঠিরমাথা এলাকায় যমুনা নদী থেকে দুটি লাশ উদ্ধার করা হয়েছে।
ভোলার পুলিশ সুপার মোহাম্মদ মনিরুজ্জামন জানান, বুধবার সকাল ৯টার দিকে সদর উপজেলার রাজাপুর ইউনিয়নের রামদাসপুর এলাকার মেঘনা নদীতে এক যুবকের লাশ ভাসতে দেখে এলাকাবাসী পুলিশে খবর দেয়।
পুলিশ গিয়ে লাশ উদ্ধার করে। পরে মৃতদেহের পকেটে পাওয়া মোবাইল ফোনের সিম থেকে পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করে জানা যায়, ওই যুবকের নাম ফাহাদ, বাড়ি ঝালকাঠিতে। তিনি কাঁঠালিয়া উপজেলার লুৎফর রহমান আকন্দের ছেলে এবং তেজগাঁও কলেজে বিবিএতে পড়তো। সে ঈদের ছুটি শেষে ঢাকায় ফিরছিল।
লৌহজং উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. খালেকুজ্জামান জানান, ফাহাদের নাম নিখোঁজের তালিকার ৯৭ নম্বরে ছিল।
এদিকে বেলা ১১টার দিকে সদর উপজেলার কাঠিরমাথা এলাকায় নদীতে ভেসে ওঠে আনুমানিক ৩৫ বছর বয়সী আরেক যুবকের লাশ।
চাঁদপুরের হাইমচর উপজেলার নীলকমল ইউনিয়নে বুধবারও দুটি লাশ ভেসে উঠছে নদীতে। এর মধ্যে মাঝিরবাজারে উদ্ধার করা হয়েছে অজ্ঞাতপরিচয় এক নারীর লাশ। আর মিয়ার বাজারে পাওয়া লাশটি আনুমানিক ৩৩ বছর বয়সী এক যুবকের।
নীলকমল ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ইয়াসিন রতন জানান, সকালে মাঝিরবাজার এলাকায় মেঘনা নদীতে লাশ ভাসতে দেখে এলাকাবাসী খবর দেয়। পরে মৃতদেহগুলো উদ্ধার করা হয়।
শরিয়তপুরের নড়িয়া উপজেলার চর আত্রা এলাকায় পদ্মা নদীতে সকালে এক নারীর লাশ ভাসতে দেখে পুলিশে খবর দেয় স’ানীয়রা।
নড়িয়ার ইউএনও মনিরা বেগম জানান, লাশটি উদ্ধারের পর তারা নিশ্চিত হয়েছেন যে মেয়েটি নৌমন্ত্রীর ভাগ্নি জান্নাত নাঈম লাকী। লাকী চীনের একটি মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তেন।
এদিকে মুন্সীগঞ্জের লৌহজং থানার ওসি তোফাজ্জল হোসেন জানিয়েছেন, শরিয়তপুরের নড়িয়ার সুরেশ্বর ওয়াপদা এলাকায় দুটি লাশ ভাসতে দেখা গেছে বলে প্রত্যক্ষদর্শী এক লঞ্চ যাত্রী মাওয়ায় পুলিশ প্রশাসনকে জানিয়েছেন।
অপরদিকে, ঘটনাস’ল থেকে আড়াই কিলোমিটার পূর্ব দিকে ভেসে উঠেছে এক নারীর লাশ।
উদ্ধার অভিযানে থাকা ফায়ার সার্ভিসের ওয়্যারহাউস ইন্সপেক্টর ফয়সালুর রহমান জানান, তারা বুধবার বিকালে পদ্মা নদী থেকে লাশটি উদ্ধার করে নৌবাহিনীর কাছে হস-ান-র করেছেন।
তিনি বলেন, বিআইডব্লিউটিএর কাছ থেকে খবর পেয়ে আমরা বোট নিয়ে মাওয়া ঘাট থেকে পাঁচ কিলোমিটার পূর্বে ওই এলাকায় যাই। নিহত মহিলার বয়স আনুমানিক ৩৫ থেকে ৪০ বছর।
লাশটি অনেকটাই ফুলে গেছে বলে ফয়সালুর জানান।
সোমবার বেলা ১১টার দিকে কাওড়াকান্দি থেকে তিন শতাধিক যাত্রী নিয়ে মাওয়া ঘাটে যাওয়ার পথে লৌহজং ক্রসিংয়ে ডুবে যায় লঞ্চ এমএল পিনাক-৬।
দুর্ঘটনার পরপরই নদী থেকে দুই নারীর লাশ উদ্ধার করা হয়। এছাড়া স্বজনদের অভিযোগের ভিত্তিতে ১৬৯ জন নিখোঁজ যাত্রীর একটি তালিকা তৈরি করেছে লৌহজং থানা পুলিশ।
মঙ্গলবার রাতভর কয়েকটি নৌযান নিয়ে চলে সমন্বিত তল্লাশি অভিযান ‘ল্যাডার স্ক্যানার সার্চ’। বুধবার সকাল থেকেও তা চলছে। কিন’ কোনো ফল আসেনি।
এদিকে স্বজন হারানো শত মানুষ মাওয়া ঘাটে উন্মুখ হয়ে তাকিয়ে আছেন পদ্মার দিকে। তাঁদের শোকের বিলাপে ভারী হয়ে গেছে পদ্মা তীরের আকাশ-বাতাস। এছাড়াও মাদারীপুরের কাওড়াকান্দি ও কাঁঠালবাড়ী ঘাটে নিখোঁজ স্বজনদের প্রতীক্ষা। থেমে থেমে স্বজনদের আহাজারিতে নদীর দুই তীরের বাতাস ভারী হয়ে উঠছে। চলছে শোকের মাতম।
সোমবার দুজনের লাশ পাওয়ার পর আর কোনো মৃতদেহ পাননি উদ্ধারকর্মীরা। স্বজনদের অভিযোগের ভিত্তিতে লৌহজং থানার করা তালিকা অনুযায়ী নিখোঁজ রয়েছেন ১৬৯ জন।
লৌহজং থানার ওসি তোফাজ্জল হোসেন জানান, পদ্মার তীরে ছুটে আসা স্বজনদের অভিযোগের ভিত্তিতে মঙ্গলবার সন্ধ্যা পর্যন- নিখোঁজ ১৬৯ জনের একটি তালিকা করেছেন তারা। তবে এর আগে জেলা প্রশাসক মো. সাইফুল হাসান বাদল ১৩৩ জনের তালিকা করার কথা জানান।
সোমবার দুর্ঘটনার পর উদ্ধার হওয়া দ্বিতীয় লাশেরও পরিচয় পাওয়া গেছে। নিহত হাসি বেগম (৫০) মাদারীপুর জেলার শিবচর উপজেলার উতরাইল গ্রামের বাসিন্দা ছিলেন। তিনি তার ভাই হান্নানের সঙ্গে টঙ্গী যাচ্ছিল।
অন্যজন ঢাকার শিকদার মেডিকেল কলেজের দ্বিতীয় বষের্র ছাত্রী নুসরাত জাহান হীরা (২০) ঈদের ছুটি শেষে ফিরছিলেন। সোমবার তার লাশ উদ্ধারের পর মাদারীপুরের শিবচর উপজেলার কাদেরপুর গ্রামে রাতেই দাফন করা হয়।
উদ্ধার অভিযানে থাকা নৌবাহিনীর ক্যাপ্টেন নজরুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, যে স’ানে লঞ্চটি ডুবেছিল, আমরা তার আশপাশে ৩৬ কিলোমিটার জায়গায় তন্ন তন্ন করে খুঁজেছি। কিন’ এখন পর্যন- সিগনেফিকেন্ট কোনো অবজেক্ট আমরা পাইনি। সেরকম কিছুই আমাদের নজরে আসেনি।
উদ্ধারকারী জাহাজ রুস-মের পর নির্ভীকও মঙ্গলবার দুর্ঘটনাস’লে পৌঁছেছে। এর বাইরেও বিআইডব্লিউটিএর জাহাজ, টাগ বোট, স্পিডবোট মিলিয়ে উদ্ধার অভিযানে রয়েছে ১৫টি নৌযান।
বর্ষার প্রবল স্রোতের মধ্যেও সনাতনি পদ্ধতিতে দড়িতে বেঁধে নোঙর ফেলে পিনাক-৬ এর অবস’ান জানার চেষ্টা করেছে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স। এতে অংশ নিচ্ছেন ২৭ জন ডুবুরি। আর আকাশে টহল দিচ্ছে নৌবাহিনী, র্যাব ও পুলিশের হেলিকপ্টার।
তারপরও উদ্ধার কার্যক্রমে কোনো ‘পজেটিভ আউটকাম’ আসেনি বলে জানিয়েছেন বিআইডব্লিউটিএর চেয়ারম্যান শামসুদ্দোহা খন্দকার।
এই পরিসি’তিতে সবাই অপেক্ষা করছেন চট্টগ্রাম বন্দর থেকে সমুদ্র জরিপে ব্যবহৃত ‘সাইড স্ক্যান সোনার’, ‘গ্লোবাল পজিশনিং সিস্টেম’ ও ‘সাব বটম প্রোপেলার’ আসার জন্য। বুধবার দুপুরের দিকে সেগুলো মাওয়ায় পৌঁছাতে পারে।
এসব যন্ত্রপাতি নিয়ে চট্টগ্রাম বন্দরের সার্ভে ভেসেল জরিপ-১০ মঙ্গলবার দুপুরে মাওয়ার পথে রওনা হলেও বৈরি আবহাওয়ার কারণে সন্দ্বীপ চ্যানেলের কাছাকাছি এলাকা থেকেই ফিরে যায় নৌযানটি।
পরে চট্টগ্রাম বন্দরের টাগবোট কাণ্ডারী-২ এসব যন্ত্রপাতি নিয়ে মুন্সীগঞ্জের পথে রওনা হয় বলে বন্দর কর্মকর্তারা জানান।
লঞ্চ ছোট এবং কাঠের তৈরি বলে খরস্রোতা নদীতে তলিয়ে গেলে এর ওপর পলি জমতে পারে বলে ক্যাপ্টেন নজরুলের ধারণা। তাহলে সাইড স্ক্যান সোনারে এটি নজরে আসার কথা নয়।
বর্তমানে যে সাইড স্ক্যান সোনার দিয়ে কাজ চলছে, তা নদীর গভীরে ৭৫ ফুট পর্যন- এলাকা স্ক্যান করতে পারে। জরিপ-১০ এর যন্ত্রপাতি দিয়ে আড়াইশ’ ফুট পর্যন- স্ক্যান করা যায়।
উদ্ধারকর্মীরা আশা করছেন, জরিপের যন্ত্রপাতি এসে পৌঁছালে নতুন করে তল্লাশি অভিযান শুরু করা যাবে।
উদ্ধারকর্মীরা বলছেন, যতো সময় যাচ্ছে, ডুবে যাওয়া লঞ্চটির স্রোতের টানে নদীর তলদেশে বহুদূর সরে যাওয়ার আশঙ্কা ততো বাড়ছে। আর সেটি কোথাও আটকে গেলে দ্রুত পলির নিচে ঢাকা পড়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
বর্ষা মৌসুমে নদীতে প্রচুর পলি আর বালি থাকে বলে সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে লঞ্চটি খুঁজে পাওয়ার সম্ভাবনাও ধীরে ধীরে কমে আসছে।
বিআইডব্লিউটিএর চেয়ারম্যান শামসুদ্দোহা মঙ্গলবার সন্ধ্যায় সাংবাদিকদের বলেন, নদীতে মঙ্গলবার থেকেই তীব্র স্রোত। ফলে লঞ্চটি ডাউন স্ট্রিমে চলে যাওয়ার কথা। যে জায়গায় লঞ্চ ডুবেছে তার সংলগ্ন ২০ কিলোমিটার নদীতে সাইড স্ক্যান সোনার দিয়ে লঞ্চ খোঁজার চেষ্টা হচ্ছে। তবে এখন পর্যন- কোনো পজেটিভ আউটকাম পাইনি।
চেয়ারম্যান জানান, উদ্ধারকারী জাহাজ রুস-ম ও নির্ভীক দুর্ঘটনাস’লে এসে বসে থাকলেও লঞ্চের অবস’ান জানা সম্ভব না হওয়ায় সেগুলো এখনো কাজই শুরু করতে পারেনি।
ফায়ার সার্ভিসের ডুবুরি হুমায়ুন কবির জানান, তারা তল্লাশি চালানোর চেষ্টা চালিয়ে গেলেও প্রবল গ্রোতের কারণে সুবিধা করতে পারছেন না।
বিআইডব্লিউটিএর পরিচালক শফিকুল হক জানান, মাওয়া লঞ্চ ঘাট থেকে পৌনে ১ কিলোমিটার দূরে লৌহজং চ্যানেলে লঞ্চটি ডুবেছে ধরে নিয়ে ‘সাইড স্ক্যানার সোনার’ দিয়ে নৌযানটি খোঁজা হচ্ছে।
নদীর ওই এলাকায় পানির গভীরতা ৮০ থেকে ৯০ ফুট। সেখানে পানিতে একটি প্রবল ঘূর্ণাবর্ত রয়েছে। বেঁচে যাওয়া যাত্রী ও প্রত্যক্ষদর্শীদের সঙ্গে কথা বলেই ওই জায়গাটি তল্লাশির জন্য চিহ্নিত করা হয়েছে।
এখনো চিহ্নিত হয়নি লঞ্চটির অবস্থান পদ্মার ভাটিতে ও মেঘনার বিভিন্ন স্থানে ভেসে উঠছে লাশ
Wednesday, August 6, 2014
Labels:
# আমাদের সিলেট
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
No comments:
Post a Comment