মানবজমিন: বিরোধী নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া দল গোছানোর ব্যাপারে উভয় সঙ্কটে। দল গোছাতে গেলে তাকে কড়া সিদ্ধান্ত
নিতে হবে। নতুবা আপসের চোরাবালিতে আত্মসমর্পণ করতে হবে। তাই তিনি সময় নিচ্ছেন। কথা ছিল মার্চে দলের কাউন্সিল হবে। এখন বলা হচ্ছে উপজেলা নির্বাচনের পর। তখনও যে হবে তা কিন্তু কেউ নিশ্চিত করে বলতে পারছেন না। সামপ্রতিক আন্দোলন ব্যর্থ হওয়ার পেছনে সাংগঠনিক ব্যর্থতা সর্বাংশে দায়ী। খালেদা এটা স্বীকার করেন ঘরোয়া আলোচনায়। কিন্তু কোন সিদ্ধান্ত নিতে পারছেন না। একটাই ভয়, কড়া সিদ্ধান্ত নিতে গেলে দলে বিভক্তি এসে যেতে পারে। বেগম জিয়ার সঙ্গে ঘন ঘন বৈঠক করেন এমন একজন বুদ্ধিজীবী বললেন, ম্যাডাম জানেন কোথায় কি হচ্ছে। কারা কিভাবে আন্দোলনকে সাবোটাজ করেছে। এখনও কারা সরকারের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রেখে চলেছে। তারপরও তিনি চুপ রয়েছেন। পরামর্শক এই বুদ্ধিজীবীর মতে, এভাবে চলতে থাকলে নিকট ভবিষ্যতে খালেদা জিয়া সুনির্দিষ্ট কোন লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারবেন বলে মনে হয় না। কারণ সরকার ভীষণ তৎপর। তারা নানাভাবে খালেদার গতিরোধ করার চেষ্টা করছে। মামলা-হামলার পাশাপাশি গুম-খুন অব্যাহত রয়েছে। ফলে এক ধরনের আতঙ্ক বিরাজ করছে দলের নেতাকর্মীদের মধ্যে। ধরা যাক বিএনপির মূল নীতিনির্ধারণী কমিটির কথা। ১৯ সদস্যের স্থায়ী কমিটির মধ্যে মাত্র চার থেকে পাঁচজন সক্রিয়। বাকিরা গা বাঁচিয়ে চলেছেন। কেউ অসুস্থ। কেউ সভা ডাকলে আসেন। অন্য সময় বাড়িতে বসে সময় কাটান। এমনকি সভা-সেমিনারেও যান না। দলের সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান লন্ডনে চিকিৎসাধীন। বর্তমানে রাজনৈতিক আশ্রয়প্রাপ্ত। দলের সঙ্কটকালে দলকে সঠিক পথে পরিচালনা করার চেষ্টা করেন। ৫ই জানুয়ারি বিতর্কিত নির্বাচনের আগে খালেদা জিয়াকে অন্তরীণ করা হলে তারেক রহমান লন্ডন থেকে দু’টি ভিডিও বার্তা পাঠান। এতে দলের নেতাকর্মীরা কিছুটা চাঙ্গা হন। অন্য নেতারা গা-ঢাকা দিয়ে বসেছিলেন। সরকার জানতো তারা কোথায় আছেন। কিন্তু কোন এক রহস্যজনক কারণে তারা গ্রেপ্তার এড়াতে সক্ষম হন। তারেকের ভিডিও বার্তা নিয়েও দলের কোন কোন নেতা সমালোচনা করেন। তারা বলেন, এতে দলে সমন্বয়হীনতা প্রকট হয়েছে। বিশেষ করে শমসের মবিনের সঙ্গে কথোপকথন ফাঁস হওয়ায় বিভ্রান্তি তৈরি হয়।
ড. আর এ গনি মেলাকাল থেকে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য। দলে তার কোন ভূমিকা নেই। দলের স্থায়ী কমিটির বৈঠকে হাজির থাকা ছাড়া দৃশ্যমান কোন তৎপরতা চোখে পড়ে না। সঙ্কটকালেও নীরব থাকেন। আন্দোলনকালে একদিন পুলিশ তাকে গুলশান থেকে উঠিয়ে ধানমন্ডিতে নিয়ে ছেড়ে দিয়েছিল। রটেছিল গ্রেপ্তারের খবর। পরে দেখা গেল সঠিক নয়। এম শামসুল ইসলাম। এক সময় সক্রিয় ছিলেন। অসুস্থতার কারণে তিনি দলের বৈঠকেও হাজির হতে পারেন না। বেগম সারোয়ারী রহমান মাঝে-মধ্যে স্থায়ী কমিটির বৈঠকে আসেন। কোন রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে নেই। সাবেক স্পিকার জমির উদ্দিন সরকার। আইন পেশা নিয়ে ব্যস্ত। বগুড়া থেকে নির্বাচিত হলেও কোন উল্লেখযোগ্য কাজ দেখাতে সক্ষম হননি। বৈঠকে সরব থাকেন। তবে দলের সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডে একদম অনুপস্থিত। সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত। কাশিমপুর কারাগারে বসে রাজনীতি বিশ্লেষণ করছেন। দিন গুনছেন কোথায় গিয়ে সমাপ্তি হবে চলমান এই পরিস্থিতির। খন্দকার দেলোয়ার হোসেন মারা গেছেন অনেক বছর হয়ে গেল। তার শূন্যস্থান পূরণ করা হয়নি। কেন হয়নি তার কোন জবাব নেই। সঙ্কটকালে খন্দকার দেলোয়ার হোসেনের অবদানের কথা খালেদা বরাবর স্মরণ করেন। ক’দিন আগেও রাজবাড়ী যাওয়ার পথে তার কবর জিয়ারত করেছেন। মির্জা আব্বাস আছেন, নেই। মাঝে মধ্যে গরম বক্তৃতা করে অনেকদিন অফ হয়ে যান। কারাগারেও ছিলেন কয়েকবার। সর্বশেষ আন্দোলনের সময় অত্যন্ত সফলভাবে পুলিশকে ফাঁকি দিতে পেরেছেন। অন্যের ওপর দোষ চাপানোর মধ্যে নিজের সফলতা খুঁজতে বেশি পছন্দ করেন। ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক থাকাকালে জিয়াউর রহমান তাকে দলে টেনে নেন। কথাবার্তা চাল-চলনে রুচিবোধসম্পন্ন এই রাজনীতিক ‘দুর্নীতি’র কাছে হার মেনে নিজেকে চরম বিতর্কিত করে ফেলেছেন। ফলে তার কথাবার্তা বক্তৃতায় বাস্তবতা থাকে অনুপস্থিত। নেতাকর্মীরাও সহজে নেন না তাকে। ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ। আগাগোড়াই নানাভাবে আলোচিত দলের মধ্যে। শুরুতে আওয়ামী লীগ। পরে বিএনপি। এর পরে জাতীয় পার্টি। সেখান থেকে বিএনপিতে। অনেকদিন হয়ে গেল বিএনপিতে। লেখালেখির কারণে মাঝে মধ্যেই শিরোনাম হয়ে যান। তাকে নিয়ে নানা সংশয় দলের মধ্যেই। যদিও তিনি বারবার জেলে যাচ্ছেন রাজনৈতিক কারণে। এর পরেও কেন তিনি দলনেত্রীর পরিপূর্ণ আস্থা অর্জন করতে পারলেন না তা নিয়ে রহস্য রয়েই গেছে। যতক্ষণ বাইরে থাকেন ততক্ষণ থাকেন সক্রিয়। তার কথাবার্তায় যুক্তি থাকে। গ্রহণযোগ্যতাও আছে। ওয়ান-ইলেভেনের সময় তার ওপর নির্যাতনের মাত্রা বাড়ানো হলেও আত্মসমর্পণ করেননি। রটনা আছে, শেখ হাসিনার নেতৃত্বে গঠিত সরকারের অধীনেও নির্বাচনে যাওয়ার পক্ষে মত দিয়ে আসছিলেন। এটাকে অনেকে ষড়যন্ত্র বলে প্রচার করছেন। খালেদা জিয়ার বাড়ি হাতছাড়া হওয়াসহ কয়েকটি আইনি লড়াইয়ে তার ভুল পরামর্শকে বেশ বড় করে দেখা হয় দলের মধ্যে।
সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল মাহবুবুর রহমান অনেকটা নাটকীয়ভাবে বিএনপির মতো দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করেছিলেন। যদিও অনেকে বলেন, দিনাজপুরে বাড়ি তাই এই সুযোগ পেয়েছিলেন। সংস্কারপন্থি খেতাবপ্রাপ্ত এই নেতা মাঝে মধ্যে পত্রিকায় সাক্ষাৎকার দেন। প্রেস ক্লাবে অখ্যাত কিছু সংগঠনের ব্যানারে আয়োজিত অনুষ্ঠানে গিয়ে বক্তব্য রাখেন। ধরি মাছ না ছুঁইয়ের মতো। এর কোন প্রভাব পড়ে না রাজনৈতিক অঙ্গনে। এ জন্যই কিনা জানি না তাকে কখনও জেলে যেতে হয়নি। চীনা লবির সঙ্গে সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ করার দায়িত্বপ্রাপ্ত এই নেতা এখন বলছেন, দলের নীতি ভুল। আমি কি করবো? তরিকুল ইসলাম। বামপন্থি এই রাজনীতিকের ভূমিকা দলের মধ্যে প্রশংসিত। দুর্ভাগ্য একটাই শারীরিক অসুস্থতা তার গতিরোধ করছে বারবার। তার রাজনৈতিক বিশ্বাস নিয়েও কেউ কোন প্রশ্ন তুলতে পারেননি কখনও। দলে সক্রিয় হওয়ার সুযোগ পেয়েও হাতছাড়া করেছেন। নিজ জেলা শহরে থাকাকেই বেশি পছন্দ করেন। ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) হান্নান শাহ সাহসী ও দৃঢ়চেতা। বারবার জেলে যাচ্ছেন। বিশেষ করে ওয়ান ইলেভেনের সময় একাধিকার জেলে যান। তবুও সংস্কারপন্থির তালিকায় নাম লেখাননি। বেগম জিয়ার অত্যন্ত আস্থাভাজন এই নেতা কুশলী নন বলেই বলাবলি রয়েছে। তাছাড়া অন্য একটি অভিযোগ রয়েছে যার কোন বিশ্বাসযোগ্য ভিত্তি নেই। এম কে আনোয়ার স্বচ্ছ এক রাজনীতিক। আমলা কাম এই রাজনীতিক জীবনে নির্বাচনে হারেননি। এলাকায় রয়েছে তার গণভিত্তি। যা বিশ্বাস করেন তা-ই বলে ফেলেন কোন সম্ভাব্য পরিণতির কথা না ভেবে। অসুস্থতাও তাকে সক্রিয় করা থেকে বিরত রাখছে।
ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়া স্থায়ী কমিটির সক্রিয় সদস্যদের একজন। নেতাকর্মীদের কাছেও তার ভূমিকা এখন প্রশংসিত। আদালত পাড়ায়ও তিনি সরব রয়েছেন।
নজরুল ইসলাম খান। শ্রমিক নেতা থেকে জাতীয় নেতা। মাঝপথে রাষ্ট্রদূতের দায়িত্বও পালন করেন। তার কাছ থেকে দল অনেক কিছুই পাবে এমনটা আশা করতেন বেগম জিয়া। কিছু হলেই হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার প্রবণতা বড্ড বেশি। যদিও তিনি অসুস্থ। শ্রমিক দলের নেতৃত্ব কব্জায় রেখে কি অবদান রেখেছেন এটা গুলশান অফিসে প্রকাশ্যে আলোচনা হয়। যে আলোচনা কানে গেলে তাকে হয়তো লজ্জা পেতে হবে।
গয়েশ্বর চন্দ্র রায়। সোজাসাপ্টা কথাবার্তা বলতে পছন্দ করেন। কিন্তু কোথায় যেন বন্দি তিনি। সময়মতো সাহসী হতে পারেন না। বরং স্রোতের বিপরীতে মন্তব্য করে গণমাধ্যমের শিরোনাম হন। অথচ তার পক্ষেই সোচ্চার হওয়ার সুযোগ ছিল বেশি।
ড. আবদুল মঈন খান। বিশ্বব্যাংকের চাকরি ছেড়ে রাজনীতিতে এসেছিলেন। রাজনৈতিক পরিবারের সন্তান ড. মঈন খান নিজেকে গুটিয়ে রাখতে ভালবাসেন বেশি। তার মধ্যে হতাশাও কাজ করে। ইদানীং কূটনৈতিক দূতিয়ালিতে নিজেকে নিয়োজিত রেখেছেন। গতানুগতিক রাজনীতির প্রতিও তার এক ধরনের অনীহা রয়েছে। পদাধিকার বলে স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। পিতা মন্ত্রী ছিলেন। তিনি নিজেও প্রতিমন্ত্রী হয়েছিলেন। কলেজের চাকরি ছেড়ে পৌরসভা চেয়ারম্যান হয়েছিলেন। এখন বিএনপির নিয়ন্ত্রকদের একজন। তাকে নিয়ে এখন আলোচনা-সমালোচনা বিস্তর। মামলা-মোকদ্দমার মধ্যে ডুবে আছেন। ভারপ্রাপ্তের খেতাব থেকে মুক্তি পাননি এই নেতা। দলকে সঠিক পথে পরিচালনা করতে সক্ষম হননি এই অভিযোগ এখন দলের সর্বমহলে। নীতি কৌশল ঠিক করতেও মুন্সিয়ানার ছাপ রাখতে পারেননি। সৎ এই রাজনীতিক আন্দোলনের চূড়ান্ত পর্বে এমনভাবে নিজেকে আড়াল করেন যা দেখে যে কেউ সন্দেহের চোখে দেখতেই পারেন। যদিও দলনেত্রী পরবর্তীকালে বলেছেন তার নির্দেশেই নাকি তিনি আত্মগোপনে চলে গিয়েছিলেন। ২৯শে ডিসেম্বর ঢাকায় একটি পিঁপড়াও প্রবেশ করবে না- সরকার প্রধানের এমন আত্মবিশ্বাস বিরোধী রাজনৈতিক অঙ্গনে নানা প্রশ্ন ও কৌতুকের জন্ম দেয়।
খালেদা উভয় সঙ্কটে
Wednesday, March 12, 2014
Labels:
# আমাদের সিলেট
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
No comments:
Post a Comment