আমাদের সিলেট ডটকম:
নগরীর রিকাবীবাজার সংলগ্ন আবু সিনা ছাত্রাবাসে টর্চার সেল গড়ে তুলেছিল ওসমানী মেডিক্যাল কলেজ শাখা ছাত্রলীগ। আর এই টর্চার সেলের নিয়ন্ত্রণে ছিল কলেজ শাখা ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মোস্তাফিজুর রহমান রাফি। কলেজ ছাত্রলীগ সভাপতি সৌমেন দে ও সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হাইর নির্দেশে এই ছাত্রাবাসের ১০০৩ নং কৰে আটকে রেখে অতীতে নির্যাতন করা হয়েছে বিরোধী ছাত্রসংগঠনের নেতাকর্মীসহ অনেক সাধারণ মানুষকেও। জানা গেছে, গত ৬ বছর অন্তত: ২০ জনকে এখানে আটকে রেখে নির্যাতন করা হয়। এদের মধ্যে বাকীরা বেঁচে ফিরলেও চরম নির্যাতনের শিকার হওয়ায় বাঁচতে পারেননি ছাত্রদল কর্মী ও কলেজের ৪র্থ বর্ষের মেধাবী ছাত্র তাওহীদুর রহমান।
মোস্তাফিজুর রহমান রাফি ২০০৯ সাল থেকে ব্যবহার করছে এই ১০০৩ নং কক্ষটি। তার কৰই ছিল কলেজ ছাত্রলীগ ক্যাডারদের আড্ডাখানা ও অস্ত্র ভান্ডার। মদ, ফেনসিডিল, গাঁজা ও ইয়াবার মতো মাদক সেবন চলতো ওই কক্ষে বসে। ‘টর্চার সেলে’ বসে আবু সিনা ছাত্রাবাসই নিয়ন্ত্রণ হতো না। পার্শ্ববর্তী ডা. সামসুদ্দিন ছাত্রাবাসও নিয়ন্ত্রণ হতো এখান থেকে। আর রিকাবীবাজার এলাকার পুরোটা নিয়ন্ত্রণের গতি নির্ধারণ হতো ওই স্থানে বসেই।
গত ৬ বছরে কমপক্ষে ২০ জনের মতো ছাত্রকে ওই টর্চার সেলে নিয়ে নির্মমভাবে নির্যাতন করা হয়। আর প্রতিটি ঘটনায়ই আলোচিত হয় ‘টর্চার সেল’। এ কারণে টর্চার সেলে কথা জানতো মেডিকেল কলেজ কর্তৃপক্ষ। জানতো পুলিশও। মেডিকেল কলোনির বাসিন্দারা জানান, ওই রিকাবীবাজার এলাকার মাদকসহ নানা অপরাধ কর্মকাণ্ডের নিয়ন্ত্রণ হতো আবু সিনা ছাত্রাবাসের পার্শ্ববর্তী মেডিকেল কলোনি থেকে। ওই মেডিকেল কলোনিতেই ছাত্রলীগের নিয়ন্ত্রণে চলে মাদক ব্যবসা। কয়েকজন মেডিকেল স্টাফকে দিয়ে ছাত্রলীগের মধ্যমসারির নেতারা ব্যবসা করলেও সংরক্ষিত এলাকা হওয়ায় প্রশাসন ছিল নির্বিকার।
বুধবার সন্ধ্যায় টর্চার সেলে ছাত্রদলকর্মী ও ওসমানী মেডিকেল কলেজের চতুর্থ বষের্র ছাত্র তাওহীদুল ইসলাম খুনের ঘটনার পর আবু সিনা ছাত্রাবাসের আলোচিত টর্চার সেলের কাহিনী রটছে মানুষের মুখে মুখে। আবু সিনা ছাত্রাবাসে থাকা সাধারণ শিক্ষার্থীরা টর্চার সেল নিয়ে কথা বলতে নারাজ। এ টর্চার সেল তাদের কাছে রীতিমতো আতঙ্কের। কয়েকজন ছাত্র জানান, প্রায় সময়ই তারা টর্চার সেল থেকে মানুষের চিৎকার শুনেছেন। কিন্তু ভয়ে তারা কিছুই বলেননি। কখনও ফিরে তাকাননি ওই কক্ষের দিকে। বুধবারও তারা ওই সেল থেকে নিহত ছাত্রদলকর্মী তাওহীদের চিৎকার শুনেছেন। কিন’ কেউ আসেননি। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ছাত্র জানান, নিহত তাওহীদ বারবারই পানির জন্য চিৎকার করছিল। কিন’ তাকে পানি দেয়া হয়নি। উল্টো তার ওপর চলে অমানুষিক নির্যাতনের স্টিম রোলার। সন্ধ্যার দিকে আবু সিনা ছাত্রাবাসের শিক্ষার্থীরা ওই টর্চার সেল থেকে কয়েকজন কর্মীকে রড, লাঠি ও পাইপ হাতে বেরিয়ে যেতে দেখেছেন বলে জানান। সিলেট নগরীর রিকাবীবাজার এলাকার পাশেই আবু সিনা ছাত্রাবাস। এ ছাত্রাবাসে চারটি ব্লক রয়েছে। এর মধ্যে প্রথম ব্লকেই হচ্ছে ১০০৩ নম্বর কক্ষ। এ কক্ষই ছাত্রলীগের টর্চার সেল। ২০০৯ সালের আগ পর্যন্ত রাজনৈতিক দাপটের কারণে আবু সিনা ছাত্রাবাসটি ছিল ছাত্রদলের নিয়ন্ত্রণে। সরকার পরিবর্তনের পরপরই পুরো ছাত্রাবাস দখলে নেয় ছাত্রলীগ। ওই সময় পুলিশ ও র্যাবের সহায়তায় ছাত্রলীগ কর্মীরা ছাত্রাবাস দখলে নেয়। এরপর থেকে ওই ছাত্রাবাসটি দখলে রয়েছে ছাত্রলীগের। তবে, ওই ছাত্রাবাসে সাধারণত সিনিয়র ছাত্ররাই বসবাস করেন। পার্শ্ববর্তী আবু সিনা ছাত্রাবাসে বসবাস করেন জুনিয়র ছাত্ররা। আবু সিনায় সিনিয়র ছাত্ররা বসবাস করায় দাঙ্গা-হাঙ্গামা ছিল ছাত্রাবাসের নিয়মিত কারবার।
ওসমানী মেডিকেল কলেজ ছাত্রদলের সভাপতি আসলামুল ইসলাম রুদ্র জানিয়েছেন, গত ৬ বছরে ওই টর্চার সেলে ছাত্রদলের ১৫ থেকে ২০ জন কর্মীকে নিয়ে নির্যাতন করা হয়। ওই টর্চার সেলে সব ধরনের অস্ত্র মজুত রয়েছে। যখন যেটি ব্যবহার প্রয়োজন সেটি করে তারা। তিনি বলেন, আলোচিত ওই টর্চার সেলে নিয়ে তাওহীদকে নির্যাতন করা হয় এবং নির্যাতনের একপর্যায়ে টর্চার সেলেই মারা যান তাওহীদ। মৃত অবস্থায়ই তাকে হাসপাতালে নিয়ে আইসিইউতে রাখার নাটক করা হয়। পরে হাসপাতাল এলাকায় র্যাব ও পুলিশ মোতায়েন করার পর তাওহীদকে মৃত ঘোষণা করা হয়। ছাত্রদলের নেতারা জানান, প্রায় দুই বছর আগে তাওহীদের মতো ওই টর্চার সেলে ধরে নিয়ে যাওয়া হয় ছাত্রদলের সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক আশিকুর রহমান আশিককে। পার্শ্ববর্তী সামসুদ্দিন ছাত্রাবাস থেকে আশিককে ধরে নিয়ে একই কায়দায় অকথ্য নির্যাতন চালানো হয়। ওই সময় এ নিয়ে তীব্র উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। আর কখনও এ রকম নির্যাতন করা হবে না- এমন আশ্বাস পাওয়ার পর বিষয়টি সমঝোতার মাধ্যমে নিষ্পত্তি ঘটে। এর আগে একইভাবে ছাত্রদলকর্মী সাদ্দামকে ধরে নিয়ে নির্যাতন চালানো হয়। এ ছাড়া গত কয়েক বছরে ক্যাম্পাস ছেড়ে চলে গেছেন এমন কয়েকজনও ওই কক্ষে নিয়ে বেধরক মারধর করা হয়। এ সময় কয়েকজনের হাত ও পায়ের রগ কেটে দেয়া হয়। ছাত্রদল থেকে অভিযোগ করা হয়, ওই টর্চার সেলের মূল নিয়ন্ত্রক রাফি হলেও ওখানে বসে নিয়মিত আড্ডা দিত আবু সিনা ছাত্রাবাস ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হাই, সহসভাপতি মাজহারুল হক আমিন, শরীফুল ইসলাম শরীফ ও ছাত্রলীগের সহসভাপতি আসাদ হামিদ। আর ঘটনার দিন সেখানে মেডিকেল কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতি সৌমেন দেও উপস্থিত ছিলেন বলে জানিয়েছেন ছাত্রদলের কর্মীরা। এদিকে, সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজের ছাত্র তৌহিদুল ইসলাম হত্যার ঘটনায় মামলা হয়েছে।
বৃহস্পতিবার নিহতের চাচা আনোয়ার হোসেন বাদী হয়ে কোতোয়ালি মডেল থানায় এ মামলা (মামলা নং-৪) করেন। মামলায় মেডিকেল কলেজ ছাত্রলীগের ১০ নেতাকর্মীর নাম উল্লেখপূর্বক অজ্ঞাত আরও ১০ জনকে আসামি করা হয়েছে।
কোতোয়ালি ওসি আতাউর রহমান জানিয়েছেন, মামলায় মেডিকেল কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতি সৌমেনদে, সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হাই, রাফি, ফাহিম, জুবায়ের, শরীফ, অন-র, হাফিজ, পাঠান ও আশিষের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। কোতোয়ালি মডেল থানার এসআই সিরাজুল ইসলামকে মামলাটি তদন্তের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে।
মামলা হলেও এখন পর্যন্ত পুলিশ কাউকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি। ছাত্রদলের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়, খুনের ঘটনার পর প্রায় ৩ থেকে ৪ ঘণ্টা টর্চার সেলে বসে আড্ডা দেয় আসামিরা। কিন্তু রাত ৮টায় কলেজ কর্তৃপক্ষের নির্দেশেই তারা হল ত্যাগ করে চলে যায়। গতকাল বিকালে আবু সিনা ছাত্রাবাসে গিয়ে দেখা গেছে, ছাত্রাবাসের চারটি বৱকেরই প্রধান ফটক বন্ধ রয়েছে। মেডিকেল কলেজ বন্ধ ও খুনের ঘটনার পর আতঙ্ক বিরাজ করায় শিক্ষার্থীরা হল ছেড়ে চলে গেছে।
সূত্র : দৈনিক মানব জমিন
আবু সিনা ছাত্রাবাসে ছাত্রলীগের টর্চার সেল নিয়ন্ত্রণে ছিল কলেজ শাখার সাংগঠনিক সম্পাদক রাফি
Saturday, June 7, 2014
Labels:
# আমাদের সিলেট
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
No comments:
Post a Comment