আমাদের সিলেট ডটকম:
সিলেটে মরণব্যাধি এইচআইভি-এইডস আক্রান্তের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। মাত্র ১০ বছরে সিলেটে মরণব্যাধী এই রোগীর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে সাড়ে ৫শ’। এদের মধ্যে মারা গেছেন ২শ’ জনের বেশি লোক। সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রের সাথে আলাপ করে এ তথ্য জানা গেছে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, আক্রান্তদের ৯৮ ভাগই বিদেশ ফেরত শ্রমিক। এ অবস্থায় ভয়াবহ এই রোগের বিস্তার রোধে দেশে ফেরত সবাইকে বিমানবন্দর ও চেকপোস্টে পরীক্ষা করার উপর গুরুত্ব দিয়েছে চিকিৎসকরা।
১৯৯৮ সালে সিলেটে প্রথম এইডস আক্রান্ত রোগীর সন্ধান পাওয়া যায়। মধ্যপ্রাচ্যের দেশ আরব আমিরাত ফেরত এক শ্রমিকের দেহে খোঁজ মিলে এইচআইভির। এইডস নিয়ে কাজ করা বেসরকারী সংস্থা আশার আলো সোসাইটির এক জরিপে দেখা গেছে, সিলেটে ২০০৩ সালে এই রোগে আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ২৮ জন। আর চলতি বছর তা বেড়ে ৫শ’ ৬০ জনে দাঁড়িয়েছে। এদের মধ্যে মারা গেছেন ২২৮ জন। শুধু ২০১৩ সালে ৬৮ জনের দেহে এই রোগের জীবানু ধরা পড়েছে। মাত্র এক বছরে ছোট একটি অঞ্চলে এতো বেশি মানুষের শরীরে এইচআইভি এইডস-এর জীবানু ধরা পড়াকে চরম বিপদ সংকেত হিসেবে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
বিষয়টি নিয়ে কথা হয় ‘আশার আলো সোসাইটি’র সিলেট বিভাগীয় সমন্বয়কারী তাহমিনা বেগমের সাথে। উদ্বেগ প্রকাশ করে তিনি জানান, প্রতিবছর সিলেটে ৫০ জনের উপরে মানুষের দেহে এইচআইভি এইডস-এর জীবানু ধরা পড়ছে। এটা সিলেটের জন্য একটা এলার্মিং(উদ্বেগজনক) উলেখ করে তিনি বলেন, আমাদের মতো তৃতীয় বিশ্বের একটি দেশে যদি এভাবে এটি বাড়তে থাকে সেটা প্রতিরোধের ক্ষমতা রাষ্ট্রের থাকবে না। যাদের দেহে এইচআইভি এইডস-এর জীবানু পাওয়া যাচ্ছে তাদের ৯৮ ভাগই মাইগ্রেন্ট ওয়ার্কার বা তাদের স্ত্রী ও শিশু। বিদেশ থেকে আসা শ্রমিকরা এই রোগটা নিয়ে আমাদের দেশে আসে বলেও যোগ করেন তিনি।
প্রবাসীদের মধ্যে এই রোগ ছড়িয়ে পড়ার কারণ হিসেবে বিভিন্ন গবেষণায় উঠে এসেছে অশিক্ষার বিষটি। সিলেটে যেসব শ্রমিক বিদেশে কাজ করতে যায়-তাদের এইচআইভি এইডস সম্পর্কে নূন্যতম কোন জ্ঞান থাকে না। যে কারণে তারা বিদেশে গিয়ে অবাধে মেলামেশা করে নিজেদের দেহে মরণব্যাধী এইচআইভি এইডস-এর জীবানু ঢুকিয়ে ফেলে। এক পর্যায়ে এই শ্রমিকরা দেশে এসেও বৈষম্যের শিকার হওয়ার ভয়ে তাদের পরিবারের কাউকে বলতে চায় না। যার জন্য তার স্ত্রীও আক্রান্ত হয় সংক্রামক এই ব্যাধিতে। পরবর্তীতে তাদের নিষ্পাপ সন্তানরাও এইচআইভি এইডস আক্রান্ত হয়ে পড়েন।
এইচআইভি এইডস-আক্রান্ত আবদুল করিম (ছদ্ম নাম) সিলেট নগরীর একটি বেসরকারী সংস্থায় কর্মরত আছেন। তিনি জানান, ৯০ এর দশকে দুবাইয়ে কাজ করা অবস্থায় বন্ধুদের পালায় পড়ে বিভিন্ন সময় নানা অসামাজিক কাজ করেছে। ’৯৮ সালে দেশে ফিরে আসলে তার দেহে এইচআইভি এইডস-এর জীবানু ধরা পড়ে। স্ত্রীর কাছে গোপন করায় ক’মাস পর তার নিরপরাধ স্ত্রীও আক্রান্ত হয় এইডস-এ। এখন তিনি আশার আলো সোসাইটির তত্ত¡াবধানে চিকিৎসাধীন রয়েছেন।
এইচআইভি এইডস নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছেন সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের কমিউনিটি মেডিসিন বিভাগের প্রধান ডা. শিব্বির আহমদ শিবলী। দেশের মানুষকে এই রোগ থেকে বাঁচাতে দেশে ফেরত সকল প্রবাসীর বিমানবন্দর ও সীমান্তবর্তী চেকপোস্টে এইচআইভি এইডস পরীক্ষা করা প্রয়োজন বলে মনে করেন তিনি। তা না হলে এক সময় আফ্রিকার দেশগুলো ও পার্শ্ববর্তী ভারতের মতো আমাদের দেশেও মহামারি আকার ধারণ করতে পারে বলে ধারণা তার।
এদিকে, এইচআইভি এইডস প্রতিরোধে বিমানবন্দরগুলোতে কাজ শুরু না হলেও নিরপরাধ শিশুদের সংক্রামক এই রোগ থেকে রক্ষায় এগিয়ে এসেছে ইউনিসেফ। বাংলাদেশ সরকার ও ইউনিসেফের উদ্যোগে সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসহ দেশের ঝুকিপূর্ণ তিনটি অঞ্চলের বড় হাসপাতালে মা হতে শিশুদের মধ্যে এইচআইভি ও জন্মগত সিফিলিস সংক্রামক প্রতিরোধ কার্যক্রম ‘পিএমটিসিটি’ নামে একটি প্রকল্প চালু করা হয়েছে। অন্য দুটি হাসপাতাল হলো ঢাকা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় ও চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল। গত বছরের ১৯ আগস্ট শুরু হওয়া এই প্রকল্প চলবে ২ বছর।
‘পিএমটিসিটি’ প্রকল্প চালু হওয়ার পর ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আসা সকল গর্ভবতী মায়েদের বিনামূল্যে এইচআইভি এইডস- পরীক্ষা করা হচ্ছে। এ বিষয়ে ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের শিশু বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ মনোজ্জির আলীর সাথে যোগাযোগ করা হয়ে তিনি বলেন, এইডস আক্রান্ত গর্ভবতী মায়েরা ‘পিএমটিসিটি’ প্রকল্পের আওতায় এসে আমাদের পরামর্শে চললে তাদের শিশুদের এইচআইভি এইডস আক্রান্তের শঙ্কা মাত্র ২ ভাগ থাকে। ডাক্তারদের কথামতো চললে এইডস আক্রান্ত মায়ের বুকের দুধ খেলেও শিশুর এইডস হওয়ার সম্ভাবনা থাকবে না বলেও উলেখ করেন তিনি।
সিলেট ওসমানী হাসপাতালে ‘পিএমটিসিটি’ প্রকল্প চালু হওয়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত ৬২৯ জন গর্ভবতী মায়ের এইচআইভি এইডস ও সিফিলিস পরীক্ষা সম্পূর্ণ বিনামূল্যে করা হয়েছে। এদের মধ্যে ২ জনের দেহে এইচআইভি এইডস-এর জীবানু ধরা পড়েছে। আক্রান্ত মা থেকে যাতে তার শিশুর দেহে এই রোগ না ছড়ায় সেজন্য তাদের চিকিৎসার আওতায় আনা হয়েছে।
‘পিএমটিসিটি’র প্রকল্প পরিচালকের দায়িত্বে আছেন ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মদ মিজানুর রহমান। বিষয়টি নিয়ে কথা হলে তিনি জানান, মূল তিন অবস্থায় শিশুরা এইচআইভি এইডস-এ আক্রান্ত হয়। মায়ের গর্ভে থাকাকালীন সময়, প্রসবের সময় ও বুকের দুধ পান থেকে। এই তিন সময় যাতে শিশুদের নিরাপদ রাখা যায়-সেজন্যই তাদের এই উদ্যোগ বলে জানান জেনারেল মিজান। ২ বছর পরে ইউনিসেফ চলে গেলেও সরকার এই কার্যক্রম অব্যাহত রাখবে বলেও তিনি আশ্বস্ত করেন।
ওদিকে, গত নভেম্বরে চালু হলেও গতকাল মঙ্গলবার ‘পিএসটিসিটি’ প্রকল্পের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করা হয়। ওসমানী মেডিকেল কলেজের সেমিনার হলে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন ইউনিসেফের এইচআইভি এইডস- বিভাগের বাংলাদেশের প্রধান ড. তাজ উদ্দিন ওয়ে ওয়ালী। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন ওসমানী মেডিকেল হাসপাতালের পরিচালক ও ‘পিএসটিসিটি’ প্রকল্পের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মদ মিজানুর রহমান। এইচআইভি এইডস নিয়ে রিপোর্টিংয়ের সাথে জড়িত সময় টেলিভিশনের সিলেট রিপোর্টার আবদুল আহাদ অনুষ্ঠানে মাল্টিমিডিয়া পাওয়ার প্রজেক্টের মাধ্যমে সিলেটের এইচআইভি এইডস-এর চিত্র তুলে ধরেন।
আলোচনায় অংশ নিয়ে ওসমানী মেডিকেল কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ ও গাইনি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. মোরশেদ আহমদ চৌধুরী বলেন, কিছুদিন আগেও ওসমানী হাসপাতালের চিকিৎসকরা এইআইভি এইডস রোগী জানলে দৌড়ে পালিয়ে যেত। কিন্তু সেই অবস্থা এখন আর নেই। ডাক্তাররা বুঝতে পেরেছে রোগীর চিকিৎসা দিলে এর জীবানু ছড়াবে না। যে কারণে অন্যান্য রোগীর মতো এইচআইভি এইডস রোগীরাও সমান সেবা পায়। তাদের ডেলিভারীসহ সকল অপারেশন ওসমানী হাসপাতালে করা হয়।
অনুষ্ঠানে অধিকাংশ চিকিৎসক সকল শিশুকে এইচআইভি এইডস প্রতিরোধে বেসরকারী হাসপাতালেও এই সেবা চালুর দাবী জানান। তা না হলে অন্যান্য রোগীর মতো অধিক সতর্কতা ছড়া এইচআইভি এইডস-রোগীদের অপারেশন করা হলে ডাক্তারদের দেহে এই রোগের জীবানু ছড়িয়ে যাওয়ার আশংকা তাদের। কারণ হিসেবে তারা উলেখ করেন-ওসমানী হাসপাতালে এইচআইভি পরীক্ষার পর গর্ভবতী মায়েদের সেবা দেয়া হয়,কিন্ত বেসরকারী হাসপাতলের ডাক্তাররা জানেন না সে এইচআইভি পজিটিভ কি না?
সিলেটে এইচআইভি-এইডস আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে,ওসমানী হাসপাতালে ‘পিএসটিসিটি’ প্রকল্পের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন
Tuesday, February 11, 2014
Labels:
# আমাদের সিলেট
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
No comments:
Post a Comment