বিরোধী দলগুলোকে চিঁড়েচ্যাপটা করতে সবই করছে সরকার: ইকোনমিস্ট

Friday, February 7, 2014


নতুন বার্তা,লন্ডন: ১০ ট্রাক অস্ত্র মামলায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত অধিকাংশ আসামি বিরোধী দলের নেতা হওয়ার প্রসঙ্গে ‘অপরাধ এবং বাংলাদেশের রাজনীতি’ শীর্ষক একটি প্রতিবেদনে লন্ডনভিত্তিক প্রভাবশালী সাপ্তাহিক পত্রিকা ‘দ্য ইকোনমিস্ট’ বলেছে- “নিজ দেশের বিরোধী দলগুলোকে রীতিমতো চিঁড়েচ্যাপটা করার জন্য যা কিছু করতে হয় তার সব কিছু করছে সরকার। আর একটি গণতান্ত্রিক দেশের গণতন্ত্রকে অসুস্থ করার জন্য এসব পদক্ষেপ যথেষ্ট।”

শুক্রবার প্রকাশিত প্রতিবেদনটির সম্পূর্ণ অংশ নিচে তুলে ধরা হলো-


১০ ট্রাক অস্ত্র পৌঁছানোর ১০ বছর পরে শাস্তি পেলেন অভিযুক্তরা। ২০০৪ সালের এপ্রিলে দেশটির বাণিজ্যিক রাজধানী চট্টগ্রামের বন্দর থেকে খালাসের সময় পুলিশ বিপুল পরিমাণ অস্ত্রবোঝাই একটি চালান আটক করেছিল। চালানটিতে রাইফেল, সাইলেন্সারসমেত সাবমেশিনগান, ২৫ হাজার হ্যান্ড গ্রেনেডসহ চীনে তৈরি প্রায় পাঁচ মিলিয়ন ডলারের অস্ত্র ছিল।


ধারণা করা হয়, ভারতের বিরুদ্ধে ব্যবহারের উদ্দেশে পাকিস্তানি গোয়েন্দাদের সহায়তায় অস্ত্রের চালানটি বাংলাদেশে আনা হয়েছিল। ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের অশান্ত আসাম রাজ্যে বিদ্রোহের সময় ব্যবহারের জন্য অস্ত্রগুলো আনার সময় বাংলাদেশের চট্টগ্রাম বন্দরে অস্ত্রের চালানটি আটক করা হয়।


বছরের পর বছর চলে গেলেও এই বিষয়ে বাংলাদেশের আইনি ব্যবস্থা মোটামুটি থমকে ছিল। অস্ত্রের চালানের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের তখন চিহ্নিত করা হয়নি। দেশটির তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল- বিএনপির নেতা বেগম খালেদা জিয়া এই অস্ত্রসংক্রান্ত অভিযোগ নিয়ে তখন খুব একটা আগ্রহ দেখাননি। কিন্তু তৎকালীন বিরোধী দল এবং বর্তমান সরকার আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পরেই ২০০৯ সালে এই অভিযোগের বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে গ্রহণ করে এবং দোষীদের বিচারের আওতায় আনার ব্যবস্থা গ্রহণ করে। চলতি বছরের ৩০ জানুয়ারি এই বিচারের রায়ে অস্ত্রপাচারের দায়ে অভিযুক্ত ১৪ জন আসামির মৃত্যুদণ্ডের রায় দেয়া হয়। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তদের অধিকাংশ ব্যক্তিই বিরোধী দলের শীর্ষ পর্যায়ের নেতা।


উচ্চ আদালতের দেয়া এই রায় রাজনৈতিক দিকসহ আইনি দিক থেকেও যথেষ্ট গুরুত্ব বহন করে। এই অভিযোগের সঙ্গে জড়ানো হয়েছে খালেদা জিয়ার ছেলে এবং বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নামও। নিজ দেশে তারেক রহমানের বিরুদ্ধে দুর্নীতিসংক্রান্ত বেশ কয়েকটি মামলার জের ধরে বর্তমানে লন্ডনে বাস করলেও দলের পরবর্তী নেতা হিসেবে তাকেই মান্য করেন দলের শীর্ষ পর্যায়ের নেতারা। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তদের মধ্যে অন্যতম হলেন এই তারেক রহমানেরই এক তোষামোদকারী নেতা এবং তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, যিনি অস্ত্রের চালানের বিষয়ে আগে থেকে সবকিছুই জানতেন।


মৃতুদণ্ডপ্রাপ্ত বাকি আসামিদের মধ্যে রয়েছেন দেশটির সামরিক বাহিনীর সাবেক প্রধান, বাংলাদেশী গোয়েন্দা সংস্থার তৎকালীন একজন শীর্ষ কর্মকর্তা, আসামের এক বিদ্রোহী পলাতক নেতা যিনি একই সঙ্গে ভারত সরকারের ‘মোস্ট ওয়ান্টেড’ তালিকাভুক্ত এবং এছাড়াও আরো অনেকে। রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে গেলে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তদের তালিকায় মতিউর রহমান নিজামীর নামও উল্লেখযোগ্য। নিজামী বাংলাদেশের একমাত্র ধর্মভিত্তিক এবং বৃহত্তম ইসলামী রাজনৈতিক দল জামায়াত ইসলামীর এবং বিএনপি নেতৃত্বাধীন ১৯ দলীয় জোটের অন্যতম শীর্ষ নেতা। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে বিরোধী দেশ পাকিস্তানকে সহায়তার অভিযোগে এবং যুদ্ধাপরাধী হিসেবে একটি পৃথক মামলায় ইতিমধ্যে এই নেতার শুনানি বিচারাধীন আছে। ধারণা করা হচ্ছে, এই মামলাতেও দ্বিতীয়বার তার বিরুদ্ধে মৃত্যুদণ্ডের রায় দেয়া হতে পারে।


অস্ত্রপাচারের মামলায় দলটির অভিযুক্ত সদস্যদের মৃত্যুদণ্ডের রায়ের প্রতিবাদে জামায়াত ইসলামীর নেতা-কর্মীরা অব্যাহত রেখেছেন তাদের প্রতিবাদ কর্মসূচি। কিন্তু রাজপথে আন্দোলনের নামে সহিংস কর্মকাণ্ডের জন্য এই দলটি বেশ কুখ্যাত হলেও বিগত কয়েক মাস ধরে সহিংসতা সৃষ্টিতে খুব একটা ভূমিকা রাখতে পারছে না। বর্তমান সরকারের আমলে দেশ জুড়ে অসংখ্য সক্রিয় জামায়াত নেতা-কর্মীকে গ্রেফতার করা হয়েছে এবং অনেককেই হত্যা করেছে দেশটির আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। ফলে জামায়াতের সঙ্গী দেশের অন্যতম বৃহত্তম রাজনৈতিক দল বিএনপিও বর্তমানে প্রায় ভেঙে পড়েছে। নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা কিংবা ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের একতরফা নির্বাচন প্রতিহত করা কিংবা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে সরকারপতনের আন্দোলন- কোনো কিছুতেই দলটি ভূমিকা রাখতে পারছে না। কারণ দলের নেতা-কর্মীরাই কোনো আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা রাখছেন না, গ্রেফতার এড়াতে থাকছেন আত্মগোপনে।


বিপরীতে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বর্তমানে বেশ খোশ মেজাজেই আছেন। প্রধান বিরোধী দল বিএনপির নেতৃত্বে জামায়াতসহ পুরো ১৮ দলীয় জোটের বর্জন করা গত ৫ জানুয়ারির জাতীয় সংসদ নির্বাচনে একতরফাভাবে জয়ী হয়েছে তার দল আওয়ামী লীগ। পশ্চিমা বিশ্বসহ বাংলাদেশের দাতা দেশ এবং পর্যবেক্ষক দেশগুলো একযোগে তখন নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে নির্বাচন বর্জন করেছিল। তখন সমগ্র আন্তর্জাতিক বিশ্বে তীব্র সমালোচনার মুখে পড়লেও বর্তমানে উন্নত দেশগুলো শর্তসাপেক্ষে আরো পাঁচ বছর আওয়ামী লীগের ক্ষমতার পক্ষে দাঁড়াতে শুরু করেছে। এমনকি বৃটেন এবং আমেরিকার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান একটি জরিপের দোহাই দিয়ে জানিয়েছে বিরোধীরা নির্বাচন বর্জন করলেও নির্বাচনে জয়লাভ করেছে আওয়ামী লীগ, যা বর্তমান সরকারকে বেশ সুবিধাজনক স্থানে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে।


সব মিলিয়ে বাংলাদেশের বৃহত্তম প্রতিবেশী দেশ এবং বিশেষ করে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ‘বিশেষ কাছের বন্ধু’ ভারতও বেশ সন্তুষ্ট। জানুয়ারির নির্বাচনকেও সে সময় একমাত্র ভারত সরকারই স্বীকৃতি দিয়েছিল। জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসবাদের জন্য স্বর্গ হিসেবে বিখ্যাত দেশ ভারতের রাজধানী দিল্লীতে দেশটির কূটনৈতিক নীতি-নির্ধারকেরা প্রতিবেশী দেশ বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের উত্থান নিয়ে বেশ উদ্বিগ্ন। তাই ভারত সরকার বাংলাদেশে এমন কোনো দলকে ক্ষমতায় দেখতে চায় না যারা ইসলামের নীতি ‘অনুসরণ’ করে, বিশেষ করে ভারতের অন্যতম প্রতিদ্বন্দ্বী দেশ পাকিস্তানের ‘বন্ধু’ দল হিসেবে খ্যাত হলে তো নয়ই। পাশাপাশি, জীবিকা অর্জনের উদ্দেশে ভারতে যাওয়া অবৈধ বাংলাদেশী অভিবাসীর সংখ্যা কমাতেও বদ্ধপরিকর ভারত সরকার।


ভারতের ‘বন্ধুপ্রতিম’ শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ সরকারও ভারত সরকারের লক্ষ্যকে কেন্দ্র করেই এগোচ্ছে। এই লক্ষ্যেই নিজ দেশের বিরোধী দলগুলোকে রীতিমতো চিঁড়েচ্যাপটা করার জন্য যা কিছু করতে হয় তার সব কিছু করছে সরকার। আর একটি গণতান্ত্রিক দেশের গণতন্ত্রকে অসুস্থ করে ফেলার জন্য এসব পদক্ষেপ যথেষ্ট। কিন্তু এর পরেও বর্তমানে শান্ত হয়ে আছে দেশটির বিরোধী দল। কৌশলীপন্থা অবলম্বনের জন্য আপাতত বেশ কিছুদিন শান্ত থাকার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন দলটি। আদালতের ঝামেলা শেষ হওয়ার পর ভেতর থেকে দলকে সংগঠিত করে সংসদে ফিরে আসার প্রচেষ্টা হিসেবে আবারো ফিরে আসবে রাজপথে। সূত্র দ্য ইকোনমিস্ট।





Share on :

No comments:

Post a Comment

 
Copyright © 2015. Sylhet News.
Design by Herdiansyah Hamzah. Published by Themes Paper. Distributed By Kaizen Template Powered by Blogger.
Creative Commons License