খালেদার ১৫ দিন

Monday, January 13, 2014

কাফি কামাল | মানবজমিন:


২৭শে ডিসেম্বর থেকে ১১ই জানুয়ারি। দীর্ঘ ১৫ দিন। গুলশানের কূটনৈতিক এলাকার নিজ বাসভবনে অবরুদ্ধ ছিলেন বিএনপি চেয়ারপারসন ও বিরোধী জোট নেতা খালেদা জিয়া। গুলশান ২-এর ৭৯ নম্বর সড়কের ১ নম্বর বাড়ি ‘ফিরোজা’র সামনের দিকে রাশিয়ান দূতাবাসের উঁচু দেয়াল। দু’দিকের প্রবেশমুখে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছিল ৫টি বালুভর্তি ট্রাক। কয়েক স্তরে অবস্থান নিয়ে সতর্ক প্রহরায় ছিলেন র‌্যাব-পুলিশসহ গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা। ‘মার্চ ফর ডেমোক্রেসি’ কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এভাবেই ঘিরে রেখেছিল তার বাসভবন। কূটনৈতিক এলাকা হওয়ায় এমনিতেই লোকসমাগমে রয়েছে বিধিনিষেধ। তার ওপর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অবস্থানের কারণে নেত্রীর বাসভবনমুখী হতে পারেননি দলের নেতাকর্মীরা। দু’একজন সাক্ষাতের চেষ্টা করলেও তাদের হাতে পড়েছে কড়া। এমন পরিস্থিতিতে ২৭শে ডিসেম্বর রাত থেকে রীতিমতো নেতাকর্মীর সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিলেন খালেদা জিয়া। এমনকি তার আত্মীয়-স্বজনদেরও সে বাড়িতে যাওয়ার সুযোগ ছিল না। ২৯শে ডিসেম্বর ‘মার্চ ফর ডেমোক্রেসি’ কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করতে চাইলেও বাসভবনের গেটেই তাকে আটকে দেয় পুলিশ। স্বয়ং খালেদা জিয়া তাকে কার্যত গৃহবন্দি করে রাখার অভিযোগ করেন। বাংলাদেশে বিরোধী নেতার অবরুদ্ধ বাসভবনের চিত্র ফলাও প্রচারিত হয়েছে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমেও। ‘দি ইকোনমিস্ট’ একটি প্রতিবেদনে প্রকাশ করে- ‘বাংলাদেশী গণতন্ত্রের নমুনা ৭৯ গুলশান’। অবরুদ্ধ অবস্থায় অবশ্য ৩০শে ডিসেম্বর যুক্তরাজ্যের হাইকমিশনার রবার্ট গিবসন ও ৩১শে ডিসেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত ড্যান মজিনা গুলশানের বাড়িতে গিয়ে খালেদার সঙ্গে দেখা করেন। সরকারের তরফে বরাবরই বলা হয়েছে, নিরাপত্তার স্বার্থে এ ব্যবস্থা। বিরোধী জোটের অংশগ্রহণবিহীন ৫ই জানুয়ারির নির্বাচনের একদিন পর শিথিল করা হয় এ অবরোধ। ৬ই জানুয়ারি জার্মান রাষ্ট্রদূত আলবার্ট কোনৎসে ও ৭ই জানুয়ারি কানাডিয়ান হাইকমিশনার হিদার ক্রুডেন গুলশান কার্যালয়ে গিয়ে খালেদা জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। নির্বাচনের পর ৭ই জানুয়ারি প্রথম দফায় ও ৮ই জানুয়ারি দ্বিতীয় দফায় সরিয়ে নেয়া হয় সেখানে মোতায়েন করা নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের। বাসার সরকারি প্রটোকল সরিয়ে নেয়ার পর নিয়মিত কিছু নিরাপত্তা কর্মী তার বাসভবনের নিরাপত্তা দেখভাল করছেন।

অবরুদ্ধ অবস্থায় কেমন ছিলেন বিরোধী নেতা খালেদা জিয়া? কিভাবে কাটিয়েছেন দমবদ্ধ অবরুদ্ধ ১৫টি দিন? বিএনপি চেয়ারপারসন কার্যালয় সূত্র জানায়, অবরুদ্ধ অবস্থায়ও সময়ের সদ্ব্যবহার করেছেন খালেদা জিয়া। প্রতিদিন তিনি দলের বিভিন্ন জেলা ও উপজেলা নেতাদের সঙ্গে ফোনে কথা বলেছেন। জেলা ও মহানগর নেতাদের কাছে নানা বিষয়ে জবাবদিহি চেয়েছেন। তৃণমূল নেতাদের উজ্জীবিত করেছেন। সূত্র জানায়, ২৯শে ডিসেম্বর ‘মার্চ ফর ডেমোক্রেসি’ কর্মসূচিতে সরকারের কঠোর অবস্থান ও রাজধানীর নেতাদের নিষ্ক্রিয়তায় হতাশা নেমে আসে দলের তৃণমূলে। অনেক কষ্ট সহ্য করে ঢাকায় সমবেত হওয়ার পর ব্যর্থ হয়ে এলাকায় ফেরার পর অনেকেই ভেঙে পড়েছিলেন। কিন্তু খালেদা জিয়ার ফোন হতাশ নেতাকর্মীদের চাঙ্গা করেছে। এছাড়া নির্বাচনের দিন সহিংসতা এড়াতে তৃণমূল নেতাদের জোরালো নির্দেশনা দিয়েছিলেন তিনি। যার ফলে নির্বাচনের দিন সাধারণ মানুষকে কেন্দ্রবিমুখ রাখতে তারা সফল হয়েছেন। নেতাকর্মীদের সঙ্গে ফোনালাপের সময় তিনি বিভিন্ন জেলার সার্বিক চিত্র সম্পর্কে পয়েন্ট টুকেছেন ডায়েরিতে। খালেদা জিয়ার বাসভবন সূত্র জানায়, তৃণমূল নেতাদের সঙ্গে একাধিক মোবাইল নম্বরে কথা বলেছেন খালেদা জিয়া। তার কার্যালয় ও বাসভবনে কর্মরতরা নেতাদের সঙ্গে খালেদা জিয়াকে ফোনে সংযোগ ঘটিয়ে দিয়েছেন। অবরুদ্ধ থাকাকালে বাসার টেলিফোনেও বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে নানা বিষয়ে আলাপ করেছেন। সূত্র আরও জানায়, অবরুদ্ধ থাকাকালে তিনি কয়েকবার লন্ডনে চিকিৎসাধীন তার বড় ছেলে ও দলের সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে মোবাইলে আলাপ করেছেন। সে আলাপে দলের নীতিনির্ধারণী নানা বিষয়ে আলোচনাও হয়েছে। এছাড়া তারেক রহমানের মেয়ে জায়মা রহমান ও থাইল্যান্ডে চিকিৎসাধীন ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকোর পরিবার এবং তার সন্তানদের সঙ্গে একাধিকবার মোবাইলে কথা বলেছেন খালেদা জিয়া। বাসভবন সূত্র আরও জানায়, অবরুদ্ধ থাকাকালে বেশির ভাগ সময় তিনি চোখ রেখেছেন দেশী-বিদেশী নানা টেলিভিশন চ্যানেলে। বাংলাদেশ পরিস্থিতি নিয়ে বিবিসি, আল জাজিরাসহ কয়েকটি আন্তর্জাতিক চ্যানেলের সংবাদ ও বাংলাদেশী চ্যানেলগুলোর প্রাইম টাইমের নিউজগুলো দেখেছেন মনোযোগ দিয়ে। সংবাদ দেখতে গিয়ে বিনোদনের চ্যানেলেও সময় পার করেছেন কখনও কখনও। বাংলাদেশী টেলিভিশন চ্যানেলের মধ্যে একুশে টিভির প্রতিই তার বেশি আগ্রহ দেখা গেছে। বিশেষ করে নির্বাচনের দিন তার বেশির ভাগ সময় কাটিয়েছেন টেলিভিশনে দেখে। এছাড়া প্রতিদিন নিয়ম করে পত্রিকার কাটিংগুলোতে চোখ বুলিয়েছেন। এক্ষেত্রেও বিদেশী পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদনগুলো পড়েছেন বিশেষ আগ্রহ নিয়ে। আলোচকদের ওপর ভিত্তি করে কিছু টকশোও দেখেছেন। এদিকে অবরুদ্ধ অবস্থায় টেলিফোনে খালেদা জিয়া বিবিসি, ভয়েস অব আমেরিকা, লন্ডনের ফিনান্সিয়াল টাইমস ও নিউ ইয়র্ক টাইমসে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন। এর মধ্যে নিউ ইয়র্ক টাইমসের দক্ষিণ এশিয়া ব্যুরো প্রধান এলেন বেরি নিজেই গুলশানের বাসভবনে গিয়ে তার সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন। খালেদা জিয়ার বাসভবন সূত্র জানায়, অবরুদ্ধ হওয়ার পর তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে যাওয়া পেশাজীবীরা তার জন্য উপহার হিসেবে নিয়ে যান কিছু বই। সেগালোর মধ্যে নেলসন ম্যান্ডেলার জীবনী ও মালালার লেখা বই দু’টি তিনি আগ্রহের সঙ্গে দেখেছেন। এছাড়াও কিছু রাজনৈতিক বিষয়ে লেখা বই তাকে উল্টোতে দেখা গেছে। বাসভবন সূত্র জানায়, অবরুদ্ধ সময় খালেদা জিয়ার ব্যক্তিগত জীবনে তেমন কোন প্রভাব ফেলেনি। অন্যান্য সময়ের মতো রাত দুইটার দিকে তিনি ঘুমিয়েছেন। ভোরে উঠে নামাজ পড়ার পর তিনি বাসার মধ্যে কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করেন। সকালের নাস্তা সেরে দ্বিতীয় দফায় কিছুক্ষণ ঘুমান। একটু বেলা করে ঘুম ভাঙার পর শুরু হয় তার দিন। বিদেশে অবস্থানরত তার ছেলের পরিবার, জেলা নেতাদের সঙ্গে ফোনালাপ, পত্রিকার কাটিং পাঠ ও টেলিভিশনে সংবাদ দেখেই কেটেছে দিনের বাকি সময়। সন্ধ্যার পর কয়েকদিন বৈঠক করেছেন বিদেশী কূটনীতিকদের সঙ্গে। অন্যদিনগুলো সাক্ষাৎকার দিয়ে, রাজনৈতিক কৌশল পর্যালোচনা ও টেলিভিশন দেখে কাটিয়েছেন সময়।

১৫দিন অবরুদ্ধ করে রাখার পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সরিয়ে নেয়া হলে শনিবার সন্ধ্যায় রাজনৈতিক কার্যালয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন খালেদা জিয়া। তখনও তার চলাচল নিয়ে সকল মহলে ছিল অনিশ্চয়তা। অবশেষে ১৫ দিন পর শনিবার রাতে গুলশানের রাজনৈতিক কার্যালয়ে যান খালেদা জিয়া। সরকারি গাড়ি দু’টি ফিরিয়ে দিয়েছেন আগেই। শনিবার গাড়িতে ব্যবহার করেননি জাতীয় পতাকাও। দীর্ঘদিন পর দলীয় পতাকাবাহী গাড়িতে করে তিনি কার্যালয়ে যান। ৫ই জানুয়ারির নির্বাচনের পর তিনি এখন আর বিরোধীদলীয় নেতা নন। তাই সে হিসেবে প্রাপ্য প্রটোকল তুলে নেয়ার কথা বলেছিলেন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ও এলজিআরডি মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম। তবে শনিবার রাতেও তার গাড়ির সামনে-পেছনে ছিল পুলিশের দু’টি গাড়ি। দীর্ঘদিন পর খালেদা জিয়া রাজনৈতিক কার্যালয়ে গেলে সেখানে নেতাকর্মীদের ভিড় জমে। এ সময় কার্যালয়ে সামনে সারিবদ্ধভাবে অবস্থান নিয়ে কয়েক শ’ নেতাকর্মী তাকে স্বাগত জানান। আত্মগোপন থেকে ছুটে আসেন কয়েকজন সিনিয়র নেতা। তারপর দফায় দফায় শিক্ষক, সাংবাদিক ও চিকিৎসকদের কয়েকটি প্রতিনিধি দল সাক্ষাৎ করেন খালেদা জিয়ার সঙ্গে। সেখানে আলোচনার ভিত্তিতেই চলমান অবরোধ কর্মসূচি পরবর্তী কর্মসূচি ঘোষণা না করা পর্যন্ত স্থগিত করা হয়েছে। দলীয় সূত্র জানায়, ৫ই জানুয়ারির একতরফা নির্বাচন, নতুন সরকার গঠন, বিরোধী দলের আন্দোলনসহ সার্বিক বিষয়ে এ সপ্তাহের মধ্যে আনুষ্ঠানিক সংবাদ সম্মেলন করবেন ১৮দল নেতা ও বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া।





Share on :

No comments:

Post a Comment

 
Copyright © 2015. Sylhet News.
Design by Herdiansyah Hamzah. Published by Themes Paper. Distributed By Kaizen Template Powered by Blogger.
Creative Commons License