মানবজমিন: জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদকে নিয়ে তৈরি হয়েছে নয়া রহস্য। রাত ১০টায় এ রিপোর্ট লেখার সময় পর্যন্ত খোঁজ পাওয়া যাচ্ছিল না তার। বারিধারার প্রেসিডেন্ট পার্ক অথবা গুলশানে রওশন এরশাদের বাসায় নেই তিনি। কোথায় আছেন তা-ও কেউ জানাতে পারছেন না। জাতীয় পার্টি নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে না- মঙ্গলবার বেলা সাড়ে ১২টায় এক সংবাদ সম্মেলনে এমন ঘোষণা দেন এরশাদ। বনানীতে তার কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন শেষে সাবেক এই প্রেসিডেন্টের মোবাইলে একটি ফোন আসে। এরপর একটি কালো রঙের গাড়িতে করে দ্রুত ওই স্থান ত্যাগ করেন তিনি। সংবাদ সম্মেলনের পর থেকেই এরশাদের নিখোঁজ হয়ে যাওয়াকে রহস্যজনক মনে করা হচ্ছে। সংবাদ সম্মেলনে এরশাদ তার ওপর চাপের কথা খোলামেলাভাবে বলেনও। এদিন তিনি সাংবাদিকদের উদ্দেশে বলেন, ‘তোমরা আমাকে বিদ্রূপ করে লিখো না। এরশাদ সাহেব সকালে এক কথা বলে বিকালে এক কথা বলে- এমন কথা লিখো না। সব কষ্টের কথা বলা যায় না। আমি এক শৃঙ্খলিত রাজনীতিবিদ।’ রাতে প্রেসিডেন্ট পার্কের ব্যক্তিগত নিরাপত্তাকর্মীরা জানান, এরশাদ তাদের কোন তথ্য না দিয়ে একাই বের হন। এরপর আর ফিরে আসেননি। জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যানের রাজনৈতিক সচিব সুনীল শুভ রায়ের টেলিফোনে যোগাযোগ করলে ফোনটি বন্ধ পাওয়া যায়। দলের মহাসচিব এবিএম রুহুল আমিন হাওলাদারের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, উনার ফোনটি বন্ধ। কোথায় আছেন আমরাও তা বলতে পারছি না। জাপার প্রেসিডিয়াম সদস্য কাজী ফিরোজ রশীদও টেলিফোনে এরশাদকে না পাওয়ার কথা জানান।
নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ালেন এরশাদ: আবারও নাটকীয়ভাবে সিদ্ধান্ত বদল করে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দিয়েছেন জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। গতকাল জরুরি সংবাদ সম্মেলন করে তিনি এ ঘোষণা দেন। নির্বাচনকালীন সরকারে থাকা দলের মন্ত্রীদের বিষয়ে তিনি জানিয়েছেন, প্রয়োজনে তাদেরও প্রত্যাহার করে নেয়া হবে। এ বিষয়ে পরে সিদ্ধান্ত জানাব। সংবাদ সম্মেলনে এরশাদ নিজের দাখিল করা মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের ঘোষণা দিয়ে বলেন, আমার দলের যারা মনোনয়ন দাখিল করেছেন তাদেরও মনোনয়ন প্রত্যাহারের জন্য বলেছি। গত ১৭ই নভেম্বর এক সংবাদ সম্মেলন করে নির্বাচন এবং নির্বাচনকালীন সরকারে যাওয়ার ঘোষণা দেন এরশাদ। তার এ ঘোষণার পর জাতীয় পার্টিতে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। নাখোশ হন তৃণমূলের নেতাকর্মীরা। দলের প্রবীণ প্রেসিডিয়াম সদস্য কাজী জাফর আহমদ এরশাদের সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে অনুসারীদের নিয়ে পৃথক সাংগঠনিক তৎপরতা চালানোর ঘোষণা দিয়ে পরে কমিটিও ঘোষণা করেন। দলে অস্থিরতা ও ভাঙনের মুখে এরশাদ তার মত পাল্টিয়ে নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দিলেও কাজী জাফরের জাতীয় পার্টি গতকাল জানিয়েছে, তাদের আংশিক বিজয় হয়েছে। ১৩ই ডিসেম্বর পর্যন্ত তারা এরশাদের চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের অপেক্ষা করবেন। কারণ নির্বাচনকালীন সরকারে থাকায় এরশাদকে নিয়ে এখনও সন্দেহ রয়ে গেছে। এদিকে এরশাদের এ সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছে প্রধান বিরোধী দল বিএনপি। জাতীয় পার্টির তৃণমূলের নেতাকর্মীরাও এ সিদ্ধান্তে উল্লাস প্রকাশ করেন। জাতীয় পার্টির এ সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলও। তবে আওয়ামী লীগ নেতারা জানিয়েছেন, এরশাদের এ সিদ্ধান্ত শেষ সিদ্ধান্ত নয়।
গতকাল দুপুরে বনানীর কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে এরশাদ বলেন, আমি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম সব দল অংশগ্রহণ করলে নির্বাচনে যাবো, যেহেতু সব দল নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেনি, তাই জাতীয় পার্টি এ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে না। আমি আমার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেছি।
তিনি বলেন, জাতির কাছে আমি তিনটি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম। এককভাবে নির্বাচন করবো, কারও ক্ষমতায় যাওয়ার সিঁড়ি হবো না, সব দল অংশ না নিলে নির্বাচনে যাব না। এককভাব নির্বাচনের জন্য আমি ২৯৯ আসনে প্রার্থী দিয়েছিলাম। মনোনয়নপত্র জমা দেয়ার শেষ দিন পর্যন্ত অপেক্ষা করেছি। নির্বাচনের পরিবেশ নেই। সারা দেশে আগুন জ্বলছে, অর্থনীতি ধ্বংসের পথে, গার্মেন্ট জ্বলছে, মানুষের জীবনের কোন মূল্য নেই। সারা পৃথিবীর কাছে হেয়প্রতিপন্ন হয়েছি। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে মুখ দেখার অবস্থা নেই। তাই এ পরিবেশে জাতীয় পার্টি নির্বাচনে অংশ নেবে না। যেহেতু সব দল আসেনি তাই আমি নির্বাচনে যাচ্ছি না। আমি আমার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেছি।
এরশাদ সাংবাদিকদের উদ্দেশে বলেন, ‘তোমরা আমার সম্পর্কে অনেক কথা বলো, আমি নাকি সকালে এক কথা, বিকালে অন্য কথা বলি। তোমাদের এ কথার কিছুটা সত্যতাও রয়েছে। কিন্তু তোমরা এর কারণ উপলব্ধি করো না। সব কষ্টের কথা বলা যায় না। আমি শৃঙ্খলিত রাজনীতিবিদ। আমি যুদ্ধ করে চলেছি মামলার বিরুদ্ধে। কোন সুবিচার পাইনি। ১৯৯০ সালের ৬ই ডিসেম্বর ক্ষমতা ছাড়ার পরপরই আমাকে জেলে নেয়া হয়েছিল। বলা হয়েছিল আমি কুচক্রী রাষ্ট্রদ্রোহী। ৬ বছর ২ মাস জেলে ছিলাম। ইফতারে একটা মিষ্টি চেয়েছিলাম। আমাকে মিষ্টি দেয়া হয়নি। অসুস্থ ছিলাম আমার তৈরি করা হাসপাতালে আমাকে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়নি। আমি ৮ বছর সেনাপ্রধান ছিলাম। আমার সেনানিবাসের হাসপাতালে চিকিৎসা নেয়ার অধিকার আছে। আমি সেনাকুঞ্জ, অডিটরিয়াম, আর্মি স্টাফ কলেজ তৈরি করেছি। আমাকে ২০ বছর সেনানিবাসে যেতে দেয়া হয়নি। আমার নামে ৭৪টি মিথ্যা মামলা দেয়া হয়েছিল।
তিনি আবেগতাড়িত হয়ে বলেন, আমার ক্ষমতা ছাড়ার পাঁচ বছর পর মঞ্জুর হত্যা মামলা করা হয়েছে। অথচ মামলার রায় এখনও হয়নি। আশা করেছিলাম গত মাসে মামলার রায় কবে। কিন্তু মামলার রায় দুই মাস পিছিয়ে ২১শে জানুয়ারি পর্যন্ত ঝুলিয়ে দেয়া হয়েছে। ঘটনার ১৪ বছর পর যখন কোন মামলায় আমাকে আটকানো যাচ্ছিল না, তখন মঞ্জুর হত্যা মামলা করা হয়। সেই মামলা ১৮ বছর ধরে চলছে। ১৩ জন জাজ বদলি হয়েছেন। কিন্তু মামলার গতি বদল হয়নি। অর্থাৎ আমাকে ঝুলিয়ে রাখতেই হবে। কোন সাক্ষী আমার বিরুদ্ধে একটি কথাও বলেনি। এবার চুপ থাকবো না।
এরশাদ বলেন, ১৯৯০ সালের ৬ই ডিসেম্বর যখন আমাকে বন্দি করা হয়েছিল কারও কাছে প্রটেকশন চাইনি। আমি অনেক অন্যায়-অবিচার সহ্য করেছি। আমার অসহায়ত্বের কথা তোমাদের বুঝতে হবে।
এরশাদ বলেন, জীবনের শেষ প্রান্তে এসে বলছি- ‘আমি স্বাধীনভাবে রাজনীতি করতে চাই। আমি মৃত্যু ও জেলের ভয় করি না। কারও কাছে হাত পাতি না। কারও কাছ থেকে টাকা নিয়ে রাজনীতি করি না। আমার নিজের বলতে কিছু নেই। নেই কোন সম্পদ। নিঃস্ব হয়ে গেছি রাজনীতি করে। প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম সব দল অংশগ্রহণ করলে নির্বাচনে যাবো। আমি আমার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেছি। জনগণকে ভালবাসি। জনগণের ভালবাসা নিয়ে বেঁচে থাকতে চাই।
জাপা চেয়ারম্যান বলেন, অনেকে বলে আমি এক হাজার কোটি টাকা নিয়েছি। যদি টাকাই নিয়ে থাকি তাহলে নির্বাচন বর্জন করলাম কেন? তোমরা আমাকে নিয়ে বিদ্রূপ করে লিখো না।
মন্ত্রিপরিষদে জাপা নেতাদের অংশগ্রহণের প্রশ্নে এরশাদ বলেন, সর্বদলীয় সরকারের প্রস্তাব আমি দিয়েছিলাম। আমি কেবল শুরু করলাম, এ বিষয়ে এখনও সিদ্ধান্ত নেইনি। আমি নির্বাচন করবো না। নির্বাচন করার জন্য তারা মন্ত্রিপরিষদে যোগ দিয়েছিলেন। যদি নির্বাচন না হয় তাহলে তারা থাকবে কেন? তোমরা অপেক্ষা করো।
জাপা ছেড়ে কাজী জাফরের চলে যাওয়া প্রশ্নে এরশাদ বলেন, আমি ঠিক পথে ছিলাম। দুঃখের কথা তারা বুঝতে পারেননি। তবে তারা কেন গেলেন জানি না। অনেকে চলে গিয়েছিলেন। আবার ফিরে এসেছেন। আশা করি তারাও আবার ফিরে আসবেন।
জাপা নেতাদের মনোনয়নপত্র জমা দেয়ার বিষয়ে এরশাদ বলেন, আমি নির্দেশ দিয়েছি মনোনয়নপত্র তুলে নিতে। আমার দলের নেতারা মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করে নেবেন। পরিবেশ ফিরে এলে নির্বাচনে আসবেন।
উল্লেখ্য, সংবাদ সম্মেলনে এরশাদের পাশে জাতীয় পার্টির আর কোন নেতাকে দেখা যায়নি। অন্যান্য সংবাদ সম্মেলনে এরশাদের প্রেস সচিব স্বাক্ষরিত সংবাদ বিজ্ঞপ্তি দেয়া হলেও গতকাল তা দেয়া হয়নি। এবার এরশাদের নিজের হাতে লেখা সাংবাদিকদের দেয়া হয়।
এরশাদ লিখিত বক্তব্যে যা বলেন: দেশের ইতিহাসে ভয়াবহ এক সঙ্কটময় মুহূর্তে দেশবাসীর উদ্দেশে আমার কিছু বক্তব্য উপস্থাপনের প্রয়োজন বোধ করছি। দেশ-জাতি-গণতন্ত্র এবং আমার দলীয় রাজনীতির স্বার্থে আমি কতটা ত্যাগ স্বীকার করেছি- সে কথা আরও একবার স্মরণ করিয়ে দিতে চাই। দেশকে যখন আমি সমৃদ্ধির শীর্ষ পর্যায়ে নিয়ে এসেছিলাম- তখন তথাকথিত ‘গণ-আন্দোলনে’র মুখে- শুধু কোন ধরনের রক্তপাত না দেখার জন্য আমি স্বেচ্ছায় সাংবিধানিক পন্থায় ক্ষমতা হস্তান্তর করে নির্বাচনে আসতে চেয়েছিলাম। শর্ত ছিল আমাকে আমার দলকে সব দলের মতো সমান সুযোগ দিয়ে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে দেয়া হবে। কিন্তু আমি ক্ষমতা ছেড়ে দেয়ার মাত্র ৬ দিনের মাথায় অন্যায়ভাবে আমার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে আমাকে গ্রেপ্তার করা হলো। ঢালাওভাবে আমার দলের নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তার করা হলো। বাকি নেতাকর্মীদের আত্মগোপনে চলে যেতে হলো। এ পরিস্থিতির মধ্যেও আমার দলকে বাঁচিয়ে রাখার স্বার্থে আমি নির্বাচনে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। আমার সেদিনের সিদ্ধান্তের ফসল জাতীয় পার্টির আজ অবধি টিকে থাকা। সেদিনও জনগণ আমাদের পাশে ছিল। তার জন্যই বিরূপ পরিস্থিতির মধ্যেও আমরা ৩৫টি আসন পেয়েছি। আমি জেলে থেকে ৫টি আসনে বিজয়ী হয়ে এবং তা পরপর দু’বার- গণতন্ত্রের ইতিহাসে রেকর্ড সৃষ্টি করেছে। ওই সময় প্রতিটি উপ-নির্বাচনে আমার দল বিজয়ী হয়েছে।
জনতার রায় আমার পক্ষে এলেও প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার আক্রোশে আমাকে কারাগারেই আটকে রাখা হলো। জেলে আটকে রেখেই আমার বিরুদ্ধে একের পর এক সাজানো মামলা দায়েরের পৈশাচিক উৎসব শুরু করা হলো। প্রাথমিক হিসাব অনুসারে ৪২টির মতো মামলা দায়ের করা হয়েছে আমার বিরুদ্ধে। যেসব খেলো মামলা দায়ের করা হয়েছিল- তা যদি জনসমক্ষে তুলে ধরা হয় তাহলে যারা সে মামলা দায়ের করেছিলেন- আজ লজ্জায় তাদের মাথা হেঁট হয়ে যাবে, জনগণ তাদের ধিক্কার দেবে। একজন চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীকে চাকরিতে পুনর্বহালের সুপারিশ করেছি- তার জন্যও মামলা হয়েছে। ইরাকের প্রেসিডেন্টের দেয়া একটি শো-পিস পিস্তল শো-কেসে রেখেছি- তার জন্য অস্ত্র আইনে আমার বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। দেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো একজন বিদেশী রাষ্ট্রদূত আমার জন্য আদালতে সাক্ষ্য দিয়েছেন। তারপরও ওই মামলায় আমাকে সাজা দেয়া হয়েছে। মামলা চলাকালীন আইন সংশোধন করে অস্ত্র আইনের সর্বোচ্চ সাজা ৩ বছরের স্থলে ১৪ বছর করা হয়েছিল। উদ্দেশ্য ছিল- আমি যাতে জীবদ্দশায় জেল থেকে বের হতে না পারি।
আমি দেশের একজন সাবেক প্রেসিডেন্ট এবং তখন জনগণের ভোটে নির্বাচিত সংসদ সদস্য। কিন্তু তা সত্ত্বেও আমার ওপর কি অমানুষিক নির্যাতন করা হয়েছে! ৬টা বছর আমি সেহরি খেয়ে রোজা রাখতে পারি নাই- ঈদের জামাতে নামাজ পড়তে পারি নাই। একনাগাড়ে সাড়ে তিনটা বছর কারও সঙ্গে আমাকে কথা বলতে দেয়া হয়নি। অসুস্থতায় জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে চলে গেছি- তবুও কোন উপযুক্ত চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়নি। জন্ডিসে আমার বিলোরুবিন ২৯ পর্যন্ত উঠেছিল- তারপরও আমার চিকিৎসা হয়নি। বেঁচে আছি অলৌকিকভাবে।
আমার বিরুদ্ধে যেসব মামলায় সাজা হয়েছে- তার সবগুলোই ছিল প্রহসনের রায়। যে বিচারক সাজা দিতে পারেন নাই- সেই বিচারককেই মাসুল দিতে হয়েছে। জনতা টাওয়ার মামলায় বিচারপতি তার ব্যক্তিগত আক্রোশ চরিতার্থ করেছেন- তার রায়ের মাধ্যমে। জেনারেল মঞ্জুর হত্যার জন্য আমার বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে- ঘটনার ১৪ বছর পর। কোন মামলায় যখন আমাকে আটকানো যাচ্ছিল না- তখন মঞ্জুর হত্যা মামলা দায়ের করা হয়। সেই মামলা আজ ১৮ বছর ধরে চলছে। ১৩ জন বিচারক বদল হয়েছেন- কিন্তু মামলার গতি-প্রকৃতি বদলানো হয়নি। অর্থাৎ, আমাকে ঝুলিয়ে রাখতেই হবে। কোন সাক্ষী আমার বিরুদ্ধে একটি কথাও বলেননি- তথাপিও মামলা শেষ হচ্ছে না। আমার দলীয় প্রতীক লাঙ্গল- তা-ও কেড়ে নেয়ার জন্য মামলা হয়েছিল। সে মামলা এখনো উচ্চ আদালতে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে।
কেন আমি এত মামলা মোকদ্দমা-জুলুম-নির্যাতন সহ্য করে আসছি। যদি বলতাম আমি আর রাজনীতি করবো না- আর কোন নির্বাচনে অংশ নেবো না- আমার দল যে যার মতো ভাগ করে নাও- তাহলে আমাকে কোন নির্যাতন সইতে হতো না। আমি সাবেক প্রেসিডেন্টের মর্যাদা নিয়ে সুখে জীবনযাপন করতে পারতাম। কিন্তু আমার মন-মানসিকতায় রক্তে-মাংসে-চিন্তায়-চেতনায় মিশে গেছে দেশ-জাতি-গণতন্ত্র আর নিজ দলের প্রতি ভালবাসা। জীবনকালে সে ভালবাসা থেকে বেরিয়ে আসতে পারবো না বলেই আমি এতটা ত্যাগ স্বীকার করে যাচ্ছি- আর ভবিষ্যতেও এ পথেই থেকে যাবো। আমি যে দুঃখময় রাজনীতিকে বরণ করেছি- সেটাই আমার পথ ও পাথেয় হয়ে থাকবে। আমি যা কিছু করি যা কিছু বলি তার অলক্ষ্যে থাকে গণতন্ত্রের সুরক্ষা এবং আমার দলের প্রতি ভালোবাসা আর স্বার্থের চিন্তা।
বলা হয়- আমি নাকি বারে বারে কথা বদলাই। এক জায়গায় আমি গোঁ ধরে থাকি না এটা সত্য। কারণ রাজনীতিতে জেদ অমঙ্গল ডেকে নিয়ে আসে- যা বর্তমান সময়ে চলছে। এখন এক পক্ষ বলছে- কেয়ারটেকার ছাড়া নির্বাচনে যাবো না- আর একপক্ষ বলছে কেয়ারটেকার দেয়াই যাবে না। এই যে কথা না বদলানোর জেদ চলছে- এতে কি দেশের মঙ্গল হচ্ছে? মানুষ কি এখন শান্তিতে আছে? গণতন্ত্র কি নিরাপদ আছে? নির্বাচন কি অনুষ্ঠিত হওয়ার সম্ভাবনা আছে? পরিবেশ-পরিস্থিতি অনুসারে পদক্ষেপ নেয়া- কিংবা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা কি অপরাধের কিছু? যারা কথা বদলাতে পারছেন না- তারা দেশকে ধ্বংসের কোন পর্যায়ে নিয়ে গেছেন- দেশবাসীকে তা বিবেচনা করতে হবে।
সচেতন মানুষ মাত্রেই সকলের প্রত্যাশা শান্তিপূর্ণভবে ক্ষমতার হস্তান্তর। নির্বাচন ছাড়া তার কি কোনও বিকল্প পথ আছে? আমি লাশের রাজনীতি সহ্য করতে পারি না বলেই স্বেচ্ছায় ক্ষমতা ছেড়ে দিয়েছিলাম। আর এখন প্রতিদিন সারি সারি লাশ দেখতে হচ্ছে- আর সে লাশ হচ্ছে ক্ষমতার লোভের বলি। সহ্য করতে পারছি না- প্রতিদিন এই বীভৎস দৃশ্য। কোথায় চলে গেছে আমাদের জাতির সভ্যতার মানদণ্ড। আমরা মানুষ হয়ে- জ্যান্ত মানুষকে পুড়িয়ে মারছি- একজন গর্ভবতী মা আগুনে পুড়ে কাতরাচ্ছে। অনাগত শিশুটি কোন দেশে জন্ম নেয়ার জন্য মাতৃগর্ভে অপেক্ষা করছে। ওই শিশুর জন্য কোন দেশ রেখে যাওয়ার জন্য আমি আমার কথায় অনড় থাকবো। তাই আমি দ্ব্যর্থহীনভাবে বলতে চাই- ওই আগুনে পোড়া মায়ের অনাগত সন্তানের জন্য একটি আগ্নেয়গিরি দেশ আমি রাখতে চাই না। একটি শান্ত সুশীতল- শান্তিময় দেশ গড়ার জন্য সমালোচনার ভাষ্য অনুসারে শুধু সকাল-বিকাল- কেন প্রতি মুহূর্তেও যদি অবস্থান বদলাতে হয়- আমি তা-ও করতে পারবো।
আমি বলেছিলাম- সব দল নির্বাচনে না গেলে আমি নির্বাচনে যাবো না। সেসব দলের মধ্যে আমিও তো একজন। আমি ভেবেছিলাম- কাউকে না কাউকে তো এগিয়ে আসতে হবে। তাই প্রথম এগিয়ে আসার দায়িত্বটা আমিই নিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম নির্বাচন বর্জনের মধ্য দিয়ে গণতন্ত্রের অর্জন আসবে না। আসতে পারেও না। কারণ গণতন্ত্রে ক্ষমতার রদবদলে একটাই পথ নির্বাচন। আমি সেই পথেই হেঁটেছিলাম। ভেবেছিলাম- আরও দল আমাকে অনুসরণ করবে। দুর্ভাগ্য আমার দুর্ভাগ্য গোটা জাতির কোন প্রত্যাশাই পূরণ হলো না। বলেছিলাম, সুষ্ঠু-অবাধ-নিরপেক্ষ এবং নিরাপদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে আমরা নির্বাচনে থেকে যাবো। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে পরিস্থিতি আরও ঘোলাটে হয়ে যাচ্ছে। নির্বাচনের অনুকূল পরিবেশ ক্রমেই বিলীন হয়ে যাচ্ছে। তাই এ পরিস্থিতিতে আমাকেও নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়াতে হলো। এখন দেশের অনিশ্চিত গন্তব্য কোথায় গিয়ে থামবে- তা শুধু সর্বশক্তিমান আল্লাহরই জানা থাকলো।
যে কারণে সিদ্ধান্ত বদল এরশাদের: তিন কারণে নির্বাচন বর্জন করলেন জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। একটি বিশেষ পক্ষের নির্দেশনা, শক্তিধর একটি দেশের সর্বশেষ বার্তা এবং ১৮ দলীয় জোটের প্রতিরোধের ভয়ে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েও শেষ পর্যন্ত নির্বাচন থেকে সরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তিনি। সাবেক প্রেসিডেন্ট এরশাদের ঘনিষ্ঠ কয়েকটি সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে। যদিও গতকাল জরুরি সংবাদ সম্মেলনে এরশাদ বলেছেন, জাতির কাছে আমি তিনটি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম। এককভাবে নির্বাচন করবো, কারও ক্ষমতায় যাওয়ার সিঁড়ি হবো না এবং সব দল অংশ না নিলে নির্বাচনে যাবো না। আমি আমার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেছি। তবে, এরশাদের বারিধারার প্রেসিডেন্ট পার্ক ভবন সূত্রে জানা গেছে, সোমবার সন্ধ্যার পর থেকে গভীর রাত পর্যন্ত একটি বিশেষ পক্ষের প্রতিনিধিরা এরশাদের সঙ্গে দেখা করে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর অনুরোধ জানান। তারা এরশাদকে বলেন, বর্তমান অবস্থা চলতে থাকলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে। গতকাল সকালে আঞ্চলিক শক্তিধর একটি দেশের পক্ষ থেকে বিশেষ বার্তা পান এরশাদ। তার এক সপ্তাহ আগে কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের সভাপতি বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী ভারত সফর করেন। বর্তমান প্রেক্ষাপটে ভারতের সর্বশেষ অবস্থান সম্পর্কে কাদের সিদ্দিকীও একটি বার্তা পেয়েছেন- যা দূত মারফতে এরশাদ অবহিত হন। এ ছাড়া প্রার্থীদের মনোনয়নপত্র জমা দেয়ার সময় জাতীয় পার্টির প্রার্থীরা প্রতিরোধের মুখে পড়েন। বিভিন্ন স্থানে হামলা ও আক্রমণের মুখে পড়েন। এতে এরশাদ তার প্রার্থীদের নিরাপত্তা নিয়েও বিচলিত হয়ে পড়েন। এর ৪৮ ঘণ্টার মধ্যেই বদলে যায় দৃশ্যপট। আর সোমবার রাত থেকে একটি গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়ে এরশাদের পক্ষ থেকে একটি বড় ধরনের ঘোষণা আসতে পারে। অবশ্য এর দু’দিন আগেই মানসিকভাবে সিদ্ধান্ত নেন নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়াবেন এরশাদ। প্রার্থীদের উদ্দেশে বলেন, ওয়েট ফর মাই সিগন্যাল। তাই বিষয়টি দলের অন্য কোন নেতার সঙ্গে শেয়ার করেননি জাপা চেয়ারম্যান। এ কারণে এরশাদের সঙ্গে সংবাদ সম্মেলনেও গতকাল দেখা যায়নি কোন নেতাকে।
নির্বাচন বর্জনের পরপরই এরশাদ নিখোঁজ
Tuesday, December 3, 2013
Labels:
# আমাদের সিলেট
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
No comments:
Post a Comment