‘গর্ত থেকে কিভাবে বেরিয়ে এলো ওরা’

Saturday, February 22, 2014

অমিত রহমান |মানবজমিন:


নয়া নির্বাচনের জন্য চাপ বাড়ছে। মনে হচ্ছে, সময় যত গড়াবে ততই চাপের মাত্রা তীব্র হবে। শুরুতে অবশ্য সরকার বলছিল চাপ দিয়ে কোন লাভ নেই। জনগণ তাদের সঙ্গে রয়েছে। ৫ই জানুয়ারির নির্বাচন তাদেরকে নাকি ৫ বছরের ম্যান্ডেট দিয়েছে। কোন নির্বাচন? যে নির্বাচনে জনঅংশগ্রহণ নেই। পাতানো এক খেলায় জয় পেয়ে তারা দুনিয়াকে চ্যালেঞ্জ করে বসেছিলেন। কেউ কেউ সংসদে এবং বাইরে দম্ভ করে বলেছিলেন, ৫ বছরের একদিন কমও তারা ক্ষমতায় থাকবেন না। জনমত জরিপ করে তাদেরকে বলা হয়েছিল, সব শেষ। বিরোধীরা গর্তে চলে গেছে। তাছাড়া গুলির শব্দ কি তাদের কানে পৌঁছেনি? তারা কি শোনেনি অদৃশ্য হয়ে যাওয়ার খবর? অতএব তারা আর কোন ষড়যন্ত্রে পা দেবে না। তারা ভাল করেই জানে সবদিকেই জাল ফেলা হয়ে গেছে। কী স্বস্তি, বিদেশি মুরুব্বিদেরও টাইট দেয়া হয়ে গেছে। তাই ওরা আর মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে না। কিন্তু কে জানতো আওয়ামী লীগের তথা শেখ হাসিনার খাস তালুকেই বিদ্রোহ সংঘটিত হয়ে যাবে! গোপালগঞ্জের দু’টি উপজেলা নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থীদের ভরাডুবি রাজনীতিতে নতুন মাত্রা যোগ করেছে। ৯৭টি উপজেলার নির্বাচন নিয়ে সব হিসাব-নিকাশ পাল্টে গেছে। অন্তত ১৬টি উপজেলায় ভোট মেকানিজম হয়েছে। ১০টিতে প্রকাশ্য। কেন্দ্র দখল করে দিন-দুপুরে গায়েবি ভোটে বাক্স বোঝাই করা হয়েছে।

টেলিভিশন টকশোতে ৫ই জানুয়ারির পর হঠাৎ করেই দৃশ্যপট বদলে গিয়েছিল। কিছু অচেনা মুখ নানা তত্ত্ব হাজির করেছিলেন। তারা বলেছিলেন, বিএনপি শেষ। খালেদা মাইনাস। জামায়াতের তো কবর রচনা হয়ে গেছে হিংসার আগুনে। আর কোনদিন তারা দাঁড়াতে পারবে না। মাত্র এক মাসের মাথায় দেখা গেল ওরা আরও বেশি শক্তিশালী হয়েছে। জনগণ অপেক্ষায় ছিল। তারা সুযোগ পেয়ে জানিয়ে দিয়েছে ৫ই জানুয়ারির নির্বাচন মানি না। নয়া নির্বাচন দিতে হবে। সিটি করপোরেশন নির্বাচনে পরাজয়ের পর বলা হলো শহরের লোকজন সরকারের ওপর বরাবরই বিক্ষুব্ধ থাকে। গ্রামের জনগণ আওয়ামী লীগের সঙ্গে। বাস্তবে দেখা গেল গ্রামের চিত্র আরও খারাপ। এখন টকশোতে তারা নয়া যুক্তি হাজির করেছেন। বলছেন, তাতে কি? কেন্দ্রীয় সরকার তো পাঁচ বছরের জন্য নির্বাচিত হয়ে গেছে। সরকার বদলে এই নির্বাচন কোন ভূমিকা রাখবে না। কি হাস্যকর যুক্তি! জনমত তাহলে কিছুই না তাদের কাছে!

৫ই জানুয়ারির নির্বাচন দেশে-বিদেশে কোন গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। এটা নতুন করে বলার কিছু নেই। হাউস অব কমন্সে নজিরবিহীনভাবে দুই সপ্তাহের মধ্যে দু’বার বিতর্ক হয়েছে। কার্যত অনাস্থা প্রস্তাব পাস করেছে ইইউ-র পার্লামেন্ট। তামাম দুনিয়া থেকে এসেছে নয়া নির্বাচনের তাগিদ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান তো খুবই পরিষ্কার। তারা সরকারের সঙ্গে কাজ করার আগ্রহ ব্যক্ত করেছে, কিন্তু তথাকথিত পার্লামেন্টকে স্বীকৃতি দেয়নি। এর প্রমাণ গত ২৯শে জানুয়ারি অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদের প্রথম অধিবেশনে মার্কিন কোন কূটনীতিক অংশ নেননি। ৭০টি দেশের ৪০ জন প্রতিনিধি হাজির হয়েছিলেন। এর মধ্যে বেশির ভাগই নিম্নপদস্থ প্রতিনিধি বা কূটনীতিক ছিলেন। কানাডার অবস্থানও ফকফকা। তারা বলেছে, নয়া নির্বাচনের বিকল্প নেই। জনগণের অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন ছাড়া বাংলাদেশে স্থিতি ফিরবে না। উপজেলা ভোটের আগেই এই অবস্থান ছিল তাদের। এখন তো হিসাব আরও পাল্টে গেছে। মিডিয়ার মূল্যায়নও বদলে গেছে। তাই নয়া ভোটের দাবি ক্রমেই যে জোরালো হবে তাতে কোন সন্দেহ নেই। আল-কায়েদা কার্ড খেলেও কোন লাভ হয়নি। উপজেলা ভোটের আগে এই কার্ড সরকারকে সুবিধা দেবে-এই যুক্তি দেখিয়েছিলেন কতিপয় নীতিনির্ধারক। তারা বলেছিলেন, জামায়াতিদের সঙ্গে বিএনপি গুহার ভেতর থেকে বের হতে পারবে না। দুনিয়া তখন বলবে এই সরকারের সামনে আর কোন চ্যালেঞ্জ নেই। এখন অনেকেই বলছেন, হাসিনার অধীনে নির্বাচনে গেলেও খালেদা জিতে যেতেন। যদিও খালেদা এটা কখনও মানতে চান না। তার কথায়, যে মুহূর্তে বিএনপি যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিতো, ঠিক সে মুহূর্তে সরকার অন্য কোন খেলা খেলে নির্বাচন ভণ্ডুল করে দিতো। জরুরি শাসন জারি হতো। এটা নাকি প্ল্যান ‘বি’তে ছিল। বিএনপি যাতে নির্বাচনে না আসে সেটাই ছিল সরকারের প্রধান লক্ষ্য। বলাবলি আছে, বিএনপির ভেতরে শেখ হাসিনার শেয়ার রয়েছে। শেয়ারহোল্ডাররা নাকি তৎপর ছিলেন খালেদা যাতে নির্বাচনমুখী না হন। ৫ জন সিনিয়র বিএনপি নেতাকে গ্রেপ্তার করার পেছনে নাকি বড় যুক্তি ছিল, বিএনপি যাতে নির্বাচন বর্জনের দিকেই অগ্রসর হয়। তাদের কৌশল সফল হয় বটে। কিন্তু কে জানতো অল্পদিনের মাথায় আবার সামনে চলে আসবে নয়া নির্বাচনের দাবি। পশ্চিমা দুনিয়া বললে কি যায় আসে-এমন ভাব আছে অনেকের মধ্যে। টকশোতে এসেও তারা পশ্চিমা কূটনীতিকদের এক হাত নেন। গেল সপ্তাহে শাসক দলের শীর্ষপর্যায়ের এক বৈঠকে ঢাকাস্থ মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান ডব্লিউ মজিনাকে বহিষ্কারের নানা দিক নিয়েও আলোচনা হয়। প্রায় দেড় বছর হলো মজিনার সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় পর্যায়ে কথা নেই প্রধানমন্ত্রীর। মার্কিন পদস্থ কর্মকর্তাদের ঢাকা সফরের সময় মজিনা গণভবনে যান তাদের সঙ্গে। তখন কথা হয় দূরবর্তী অবস্থান থেকে। কখনও কখনও সরকারের তরফে নানা উষ্মাও প্রকাশ করা হয়। নিশা দেশাইর সামনেও এমন ঘটনা ঘটেছে। অথচ পাগলও জানে মজিনা কতটা বাংলাদেশপ্রেমী। প্রফেসর ইউনূস চ্যাপ্টার ক্লোজ হয়ে গেছে-বড়াই করে বলছেন পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম। তার পূর্বসূরি একটু ফাঁক রেখেছিলেন কূটনীতির মারপ্যাঁচে। কিন্তু শাহরিয়ার আলম দরজা বন্ধ করে দিয়েছেন। কূটনীতি এতটা সহজ নয়, শাহরিয়ার ক’দিন পরেই হয়তো টের পাবেন। দীপু মনি শূন্য হাতে ফিরেছেন। এখন এসএসএফ তার গতিরোধ করে। স্লিপ পাঠান প্রধানমন্ত্রীর সাক্ষাৎ পাওয়ার জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা গণভবনের ওয়েটিং রুমের সোফায় বসে থাকেন। তবু প্রধানমন্ত্রী সাক্ষাৎ দেন না। বিকেলে আমন্ত্রিত অতিথিদের ভিড়ে অনেকটা অনাহূতভাবে ঠাঁই করে নেন।

দুবাইয়ের ভিসা বন্ধ হওয়ার পেছনে রাশিয়াপ্রীতি কাজ করেছে বড্ড বেশি। দুবাইয়ের বিরুদ্ধে এক্সপো ২০২০-তে রাশিয়াকে বাংলাদেশ ভোট দিয়েছে। এটা জানাজানি হওয়ার কথা ছিল না। ভোটের গোপনীয়তা গোপন থাকার কথা। কিন্তু অতি উৎসাহ ও অপরিপক্ব কূটনীতি দেশটাকে বিপদে ফেলেছে। অস্ত্র কেনা হচ্ছে দেশের জন্য এটা সবাই জানেন। রাশিয়া তো বিনা পয়সায় অস্ত্র দেয়নি। তাহলে আমরা কেন ব্যালটি গোপনীয়তা ফাঁস করার মতো অস্বাভাবিক কূটনৈতিক চাল বেছে নিলাম? এটাও সবাই কম-বেশি জানেন। এখানে এটা খোলাসা করে বলার কোন প্রয়োজন নেই। দুবাইয়ের ভিসা বন্ধ হওয়ার পর যে বার্তাটি ঢাকায় পৌঁছেছে তাতে মনে হয় সামনে বড় কোন বিপদের মধ্যে পড়তে যাচ্ছি। গোটা আরব দুনিয়ায় আমাদের নাগরিকরা নানা প্রশ্নের মুখোমুখি।

কেবল মজিনায় ক্ষ্যান্ত নন, আমেরিকা হটাতেও একদল নেমে পড়েছেন। পদ্মা সেতুতে অর্থায়ন বন্ধ করে দেয়ার পরও আমরা বুঝিনি বিশ্বব্যাংকের কতটা প্রয়োজন ছিল। মার্কিন সংস্থা এশিয়া ফাউন্ডেশনের ডেপুটি কান্ট্রি রিপ্রেজেনটেটিভ সায়মা আনওয়ারকে কেন বহিষ্কার করা হলো তা নিয়ে নানা কথাই শোনা যাচ্ছে। পাকিস্তানি নাগরিক না গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগ-এটা পরিষ্কার করে কেউ বলছেন না। তবে নানা গুঞ্জন কূটনৈতিক পাড়ায়। রাষ্ট্রপরিচালনায় কিছু ভুল হতেই পারে। কিন্তু আমরা যেন ইচ্ছে করেই কারও সঙ্গে যুদ্ধ করতে যাচ্ছি।

এখন নাকি বলা হয় পিস কিপিং বন্ধ হয়ে গেলে ক্ষতি নেই। আমরা সব ক্ষতি পুষিয়ে নেবো। বিষয়টি সংবেদনশীল, তাই আশ্বস্ত করতে হচ্ছে। তাদের সঙ্গে ঘন ঘন বৈঠক নাকি এরই অংশ। বলা বড় সহজ। কই পদ্মায় কি কেউ এসেছে টাকার বস্তা নিয়ে?

জাতিসংঘ প্রতিনিধি তারানকোর বৈঠকে বিএনপির তরফে সাত দফা দেয়া হয়েছিল। এর মধ্যে চারটি পয়েন্টে একমত হয়েছিল আওয়ামী লীগ। ১৭ই ডিসেম্বরের শেষ বৈঠকে আওয়ামী লীগের এক নেতা আলোচনা ভেঙে দেন নেত্রীর সঙ্গে আরও আলোচনার কথা বলে। তখন অবশ্য ওই নেতা বলেছিলেন, ৫ তারিখ নির্বাচন হয়ে যাক। এখান থেকে আমরা ফিরতে পারবো না। তবে কয়েক দিনের মধ্যেই আমরা বসে নয়া নির্বাচনের জন্য আলোচনা শুরু করবো। মজার ব্যাপার, ওই নেতাই প্রধানমন্ত্রী বলার আগে মিডিয়াকে বলেন, পাঁচ বছরের আগে সংলাপ নয়। সম্ভবত ওই নেতা তার ‘হারানো পাঁচ বছরের’ হিসাব অন্য ভাবে মেলাতে চাইছেন। তারানকো তার রিপোর্টে সংলাপ ব্যর্থ হওয়ার জন্য শাসক দলের মনোভাবকে কার্যত দায়ী করেছেন। জাতিসংঘ মহাসচিব চুপ করে বসে আছেন। তাই বলে এটা মনে করার কারণ নেই যে, সব শেষ হয়ে গেছে। ফের চাঙ্গা হবে সবকিছু। বাকি উপজেলা নির্বাচন যদি স্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় না হয়, তাহলে বিপদ আরও বাড়বে। কারণ, সবার চোখ এখন উপজেলা নির্বাচনের দিকে। স্বচ্ছ হলে কিছুটা দম মিলবে। না হলে দু’দিক থেকেই বিপদের আশঙ্কা রয়েছে।





Share on :

No comments:

Post a Comment

 
Copyright © 2015. Sylhet News.
Design by Herdiansyah Hamzah. Published by Themes Paper. Distributed By Kaizen Template Powered by Blogger.
Creative Commons License