মানবজমিন:একতরফা নির্বাচন বর্জনে অনড় এরশাদ বিশেষ বার্তা পাঠিয়েছেন। জানিয়েছেন তিনি সম্পূর্ণ সুস্থ। গ্রেপ্তারের জন্য তাকে আটকে রাখা হয়েছে। বার্তায় এরশাদ জাতীয় পার্টির সব নেতাকর্মীকে ধৈর্য ধরার এবং ঐক্যবদ্ধ থাকার নির্দেশ দিয়েছেন। এরশাদ বলেন ,আমি কাউকে আমার মুখপাত্র নিযুক্ত করিনি। একজন নেতা (মুজিবুল হক চুন্নু) পার্টির মুখপাত্র হিসেবে বিবৃতি দিচ্ছেন বলে শুনেছি। তিনি যদি এটা করে থাকেন তাহলে এর দায়িত্বও তার নিজের এবং এটি তার নিজস্ব মতামত হিসেবে বিবেচিত হবে। পার্টির শৃঙ্খলাবিরোধী যে কোন কাজের জন্য আমি যে কারও বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারি। এরশাদ বলেন, পার্টির মহাসচিব রুহুল আমিন হাওলাদার ও প্রেসিডিয়াম সদস্য জি এম কাদের আমার কাছ থেকে প্রাপ্ত দিকনির্দেশনা দলীয় নেতাকর্মীদের কাছে পৌঁছে দেবেন। ববি’র মাধ্যমে আমি গণমাধ্যমকে আমার বক্তব্য জনাবো। অন্য কারও বক্তব্য, বিবৃতি এবং প্রচারণায় আপনারা বিভ্রান্ত হবেন না। এরশাদ বলেন, সব দলের অংশগ্রহণ ছাড়া জাতীয় পার্টি কোন নির্বাচনে অংশ নেবে না। এ জন্য ইতিমধ্যেই আমাদের দলের প্রার্থীরা তাদের মনোনয়ন প্রত্যাহার করে নিয়েছেন। গণতান্তিক অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখার স্বার্থেই এটা দরকার। এরশাদের বিশেষ উপদেষ্টা ববি হাজ্জাজ গণমাধ্যমে তার এ বার্তাটি পাঠান। এদিকে গতকাল এরশাদের সঙ্গে সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে সাক্ষাৎ করেন দলের মহাসচিব এ বি এম রুহুল আমিন হাওলাদার, প্রেসিডিয়াম সদস্য জি এম কাদের ও কাজী ফিরোজ রশীদ। সাক্ষাৎ শেষে তারা এরশাদের অনড় অবস্থানের কথা জানান। দুপুরে এক সংবাদ সম্মেলনে জি এম কাদের এরশাদকে উদ্ধৃত করে বলেন, ৫ই জানুয়ারির নির্বাচনে অংশ না নেয়ার সিদ্ধান্তে চেয়ারম্যান এখনও অটল বলে জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, নির্বাচনে আমরা অংশ নিচ্ছি না। প্রার্থিতা প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত বহাল আছে। এখনও যারা করেননি সবাইকে প্রত্যাহার করতে বলা হয়েছে। আমি মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করে নিয়েছি। মহাসচিবও প্রত্যাহার করতে পাঠিয়েছেন। বিকেলে দলের এক জরুরি প্রতিবাদ সভা শেষে অপর এক সংবাদ সম্মেলন জাতীয় পার্টির মহাসচিব এ বি এম রুহুল আমিন হাওলাদার সাফ জানিয়ে দেন, হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ জীবিত থাকতে বিকল্প কোন নেতৃত্ব চেয়ারম্যান হবেন না। তিনি বলেন, নেতাকর্মীরা চাইলে এবং প্রয়োজন হলে কর্মসূচি দেব। মহাসচিব বলেন, এরশাদ চেয়ারম্যান আছেন থাকবেন, কোন বিভ্রান্তিতে কান দেবেন না। আমি আমার মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করেছি। বেশির ভাগ আসনেই প্রার্থীরা প্রত্যাহার করেছেন। যারা করবেন না তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। তিনি বলেন, এরশাদ যেখান থেকেই নির্দেশনা ও আদেশ দেবেন আমরা তা বাস্তবায়ন করবো। চেয়ারম্যানের বনানী কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে হাওলাদার এসব কথা বলেন। ঢাকা মহানগর উত্তর আয়োজিত এ প্রতিবাদ সমাবেশে নেতাদের উদ্দেশে মাঠ পর্যায়ের কর্মীরা বলেন, প্রেসিডিয়ামের নেতারা এরশাদের সঙ্গে বেঈমানি করছেন। মাঠ পর্যায়ের নেতারা করেননি। এরশাদ ছাড়া বিকল্প চিন্তা করলে দালাল হিসেবে চিহ্নিত হবেন। কাউকে ঘর থেকে বের হতে দেয়া হবে না। নেতাদের উদ্দেশে তারা আরও বলেন, আপনারা ঠিক থাকলে এরশাদের জন্য আমরা জীবন দিতেও প্রস্তুত। তবে সরকারের সঙ্গে কারা কারা আঁতাত করছেন, তাদেরও চিহ্নিত করতে হবে। আর কোন কথা নয়, কর্মসূচি চাই। চাই নেতাকে মুক্ত করতে। এর আগে দুপুর সোয়া ১২টায় গুলশানে জাপা মহাসচিবের ব্যবসায়ীক অফিসে জরুরি সংবাদ সম্মেলনে জি এম কাদের বলেন, ‘আমাদের পার্টির চেয়ারম্যানকে যেভাবে নেয়া হয়েছে আমরা যদি বলি তা স্বাভাবিক প্রক্রিয়া ছিল তা বিশ্বাসযোগ্য হবে না। কর্তৃপক্ষ আমাদের নিশ্চিত করেছে, এরশাদ সাহেব যখন চাইবেন তখনই তিনি ফিরে আসতে পারবেন। তবে তিনি আরও কয়েক দিন হাসপাতালে থাকবেন। এ সময় জি এম কাদেরের পাশে বসা ছিলেন জাপা মহাসচিব এ বি এম রুহুল আমীন হাওলাদার ও প্রেসিডিয়াম সদস্য কাজী ফিরোজ রশীদ। সংবাদ সম্মেলনের একপর্যায়ে শতাধিক বিক্ষুব্ধ কর্মী স্লোগান দিয় বলেন, ‘এরশাদ আটক কেন, দালালরা জবাব চাই, এরশাদের কিছু হলে, জ্বলবে আগুন ঘরে ঘরে।’ বিক্ষুব্ধ নেতাকর্মীদের শান্ত করতে একপর্যায়ে সংবাদ সম্মেলন বন্ধ রেখে রুহুল আমীন হাওলাদার উঠে দাঁড়ান। রুহুল আমীন হাওলাদার বলেন, ‘আমি ১২ বছর ধরে পার্টির মহাসচিব। বিশ্বস্ততার সঙ্গে পার্টির দায়িত্ব পালন করছি। আমিই একমাত্র ব্যক্তি যে পার্টির চেয়ারম্যান ছাড়া আর কাউকে ভয় করি না। এ সময় কর্মীরা তাকে ঘিরে নানা স্লোগান দিতে থাকেন। তারা জানতে চান দলীয় চেয়ারম্যানের বাসা খালি কেন। দলীয় কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন করা হচ্ছে না কেন। এর জবাবে হাওলাদার বলেন, জরুরি কারণে এখানে সংবাদ সম্মেলন করেছি। পরে পার্টি অফিসে করা হবে। সংবাদ সম্মেলনটি তখন একটি টেলিভিশন চ্যানেলে সরাসরি সমপ্রচার করা হচ্ছিল। উত্তেজিত কর্মীরা এরশাদের কিছু হলে জ্বলবে আগুন ঘরে ঘরে বলে স্লোগান দেন। এ সময় হাওলাদার নিজের দৃঢ়তা প্রকাশ করে বলেন, আমি জাতীয় পার্টিতে আছি। জীবন গেলেও এরশাদের সঙ্গেই থাকব। এ সময় নেতাকর্মীরা আবার এরশাদের নামে স্লোগান দেন। জি এম কাদের বলেন, এ নির্বাচনে অংশ নিলে নির্বাচন অর্থবহ হবে না। দেশে স্থিতিশীলতা আসবে না। তাই তিনি (এরশাদ) নির্বাচনে অংশ না নেয়ার সিদ্ধান্তে অটল। এরশাদ অসুস্থ থাকায় কাউকে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান করা হবে কিনা- এমন প্রশ্নের উত্তরে জি এম কাদের বলেন, ‘পার্টির চেয়ারম্যান দেশের বাইরে গেলে বা কাউকে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান করলে সে ক্ষেত্রে হতে পারেন। কিন্তু আমাদের চেয়ারম্যান এখনও পার্টির চেয়ারম্যান। এ েক্েষত্রে বিভ্রান্তির কোন সুযোগ নেই।’ এর পরপরই মহাসচিবের গুলশানের বাসার সামনে থেকে থানা পুলিশ আটক করে যুবসংহতির বনানী শাখার সম্মাদক আলমগীর হোসেনকে।
ওদিকে, ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, মজিবুল হক চুন্নু, কাজী ফিরোজ রশীদ, আবু হোসেন বাবলা ও গোলাম হাবিব দুলাল গতকাল রওশন এরশাদের গুলশানের বাসায় যান। তারা সেখানে বৈঠক করেন।
যেভাবে নিয়ে যাওয়া হয় এরশাদকে: বৃহস্পতিবার রাত ১০টায় হঠাৎ প্রেসিডেন্ট পার্কের নিচে নেমে এসে স্যার কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের খোঁজ খবর নেন। জানতে চান তারা রাতের খাবার খেয়েছেন কিনা? এ সময় সেখানে অপেক্ষমাণ গণমাধ্যমের কর্মীরা তার প্রতিক্রিয়া নিতে চাইলে জাপা চেয়ারম্যান বলেন, এখন থাক। এ সময় স্যারের মন খুব খারাপ এবং বিমর্ষ ছিল। দেহরক্ষী বাদশা মিয়া এরশাদ আটকের আগের মুহূর্তগুলো বর্ণনা করে জানান, রাত ১১টায় স্যার গ্রেপ্তার হওয়ার আশঙ্কা মিডিয়াকে এবং নেতাকর্মীদের জানিয়ে দিতে বলেন। রাত ১১টা পর্যন্ত তিনি রাতের খাবার খাননি। ১১টা ২০ মিনিটে বিশেষ গোয়েন্দা সংস্থার প্রধান তার কক্ষে প্রবেশ করেন। ২০ মিনিটের মধ্যে তাকে নিয়ে প্রেসিডেন্ট পার্কের নিচে নামেন। ওই সময় নিচে অপেক্ষায় ছিলেন আরও ৬ থেকে ৭ কর্মকর্তা। প্রেসিডেন্ট পার্ক সূত্র জানায়, এ সময় এরশাদ এরিখকে একবার দেখার সুযোগ চাইলেও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তা দেয়নি। নেতাকর্মীরা তাকে গাড়িতে তোলার সময় ধস্তাধস্তি করেন। অনেকে কান্নায় ভেঙে পড়েন। সবচেয়ে বেশি চিৎকার করেন স্যার স্যার বলে দেহরক্ষী বাদশা মিয়া। তিনি সাবেক প্রেসিডেন্টের সঙ্গে প্রায় ২৬ বছর আছেন। বাসা থেকে আকাশি রঙের ফুল শার্ট ও মেরুন রঙের হাফ সোয়েটার পরে তিনি বের হন। সঙ্গে ছিলেন একান্ত সচিব মেজর (অব.) খালিদ আকতার। রাতে ও সকালে সিএমএইচের কোন খাবার না খাওয়ায় এরশাদের জন্য সকালে বাসা থেকে নাশতা পাঠানো হয়। মেন্যু ছিল খেজুর, রুটি ও জুস। দেহরক্ষী বাদশা মিয়া বলেন, স্যার হালকা খাবার খান।
এরশাদের মুক্তি দাবি করলেন ফখরুল
জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের মুক্তি দাবি করেছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। গতকাল এক বিবৃতিতে তিনি এ মুক্তি দাবি করেন। বিবৃতিতে মির্জা আলমগীর বলেন, বৃহস্পতিবার গভীর রাতে সংবাদ মাধ্যমে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান ও সাবেক প্রেসিডেন্ট হুসেইন মুহম্মদ এরশাদকে গ্রেপ্তারের সংবাদে আমরা অত্যন্ত উদ্বিগ্ন। শুধুমাত্র একটি সাজানো, পাতানো, নীলনকশার নির্বাচনে অংশ না নেয়ার কারণে এরশাদকে আটক করা হয়েছে বলে আমরা মনে করি। তার এই গ্রেপ্তারে প্রমাণ করলো, দেশে গণতন্ত্রের লেশমাত্র নেই। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব বলেন, তথাকথিত একদলীয় এই নির্বাচন একটি প্রহসন মাত্র। আমরা একটি রাজনৈতিক দলের প্রধানকে এভাবে গ্রেপ্তারের নিন্দা ও অবিলম্বে তার মুক্তি দাবি করছি।
No comments:
Post a Comment