মানবজমিন: বাংলাদেশ পরিস্থিতিতে ভারত হঠাৎ বদলে গেছে। বাংলাদেশের নির্বাচন সম্পর্কে ইতিহাসে সম্ভবত গতকালই তারা একটি বিবৃতি প্রকাশ করেছে। এই বিবৃতিটি গতকাল ঢাকার ভারতীয় হাই কমিশন থেকে প্রকাশ করা হয়। এতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের জনগণই তাদের নিজেদের ভবিষ্যৎ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে। ভারত বাংলাদেশে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন সমর্থন করছে।
এর আগে স্পষ্ট ইঙ্গিত ছিল যে, ভারত ‘সংবিধান অনুযায়ী’ নির্বাচন চাইছে। সেখানে সংলাপের কথাটি ছিল না। খালেদা জিয়াকে নিগ্রহ ও নজরদারির প্রেক্ষাপটে গতকাল ‘সংলাপের’ তাগিদ দিলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং। অথচ শেখ হাসিনা সরকার আকস্মিকভাবে পাঁচ নেতাকে গ্রেপ্তার ও খালেদা জিয়াকে গ্রেপ্তারের ঘোষণা দিয়ে সংলাপের দুয়ার বন্ধ করে দিতে চাইছিলেন বলে সমালোচকরা উল্লেখ করছিলেন।
আওয়ামী লীগের কট্টরপন্থিরা বিনা সংলাপে একতরফা নির্বাচনে উৎসাহী হয়ে পড়েছিলেন। তারা ধরেই নিয়েছিলেন যে, ভারতকে তারা সম্ভব সব দিয়েছে। তাই তারাও তাদের ক্ষমতায় টেকানোর চাহিদা পূরণ করবে। তাদেরও বিরাট স্বার্থ আছে।
মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান মজিনার আলোচিত দিল্লি সফরের পরে ওয়াশিংটনে চলে যাওয়া এবং গত কয়েকদিন ভারতের মিডিয়ায় তার সমালোচনার পটভূমিতে আকস্মিক অবাধ নির্বাচনের কথা উঠলো, তাদের মুখে সেই সঙ্গে ‘‘সংলাপ’’ , ‘‘বহুদলীয় গণতন্ত্র’’, ‘‘মতপার্থক্য’’ এবং ‘‘শান্তিপূর্ণ’’ উপায়ে তা সুরাহা করার ওপর জোর দেয়া হলো। অবশ্য নিরপেক্ষ বাংলাদেশী পর্যবেক্ষকরা বলেন, ভারত, যুক্তরাষ্ট্র বা কোন বিদেশী শক্তির কোন অবস্থান বিবেচনায় নেয়া ঠিক হবে না। কেবল মাত্র নিজেদের স্বার্থে ও নিজেদের শর্তে সমাধান বের করতে হবে। তবে ভারতের তরফে আপাতদৃষ্টিতে একটা ইউ টার্ন প্রতীয়মান হওয়া বেশ গুরুত্বপূর্ণ।
ভারত গতকাল বলেছে, ‘যেখানে বহুদলীয় গণতন্ত্র ব্যবস্থা বিদ্যমান, যেমন বাংলাদেশে, সেখানে সংলাপ ও শান্তিপূর্ণ উপায়ে সমঝোতা করাই সবচেয়ে ভাল উপায়। এসব পদক্ষেপ গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে শক্তিশালী করবে এবং বাংলাদেশের শান্তি স্থিতিশীলতা ও উন্নয়নের লক্ষ্য অর্জনে ভূমিকা রাখবে।’
ঢাকার কূটনৈতিক পর্যবেক্ষকরা লক্ষ্য করছেন যে, ভারতীয় এস্টাবলিশমেন্ট সাম্প্রতিক সময়ে সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচনের ওপর গুরুত্ব দিয়ে চলছিল। যদিও তাদের বক্তব্য হিসেবে ভারতীয় গণমাধ্যমে প্রচারিত খবর থেকে দেখা গেছে ভারতীয় সাউথ ব্লক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থানের সঙ্গে একমত হতে পারেনি। তারা এমনকি ধারণা দিচ্ছিল যে, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তাদের মতপার্থক্য ঘটেছে।
গত ১লা নভেম্বর ঢাকেশ্বরী মন্দিরে নির্বাচনের দিকে ইঙ্গিত করে ভারতের ডেপুটি হাই কমিশনার সন্দীপ চক্রবর্তী এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাষ্ট্রদূত উইলিয়ম হান্না বাংলাদেশের নির্বাচন বিষয়ে বক্তব্য রাখেন। কিন্তু ইউরোপীয় রাষ্ট্রদূত অবাধ ও সুষ্ঠ নির্বাচনের কথা বললেও ভারতীয় কূটনীতিক তা এড়িয়ে যান। তিনি অবশ্য উল্লেখ করেছেন যে, বাংলাদেশের কোন দলের সঙ্গে ভারতের কোন বিশেষ সম্পর্ক নেই। কিন্তু সম্প্রতি টাইমস অব ইন্ডিয়ার ডিপ্লোমেটিক এডিটর ইন্দ্রানী বাগচী এবং ঢাকা ভিত্তিক বিডিনিউজ২৪ ডট কমের অন্যতম জ্যেষ্ঠ সম্পাদক সুবীর ভৌমিক বাংলাদেশে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান মজিনার সাম্প্রতিক দিল্লি সফর নিয়ে মন্তব্য করেন।
গত ১লা নভেম্বর সুবীর ভৌমিক একটি লেখা দিল্লির ইকোনোমিক টাইমস ও টাইমস অব ইন্ডিয়ায় ছাপা হয়। এতে উল্লেখ করা হয় যে, ‘‘ঢাকার স্থানী মিডিয়া ভারতীয় ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূতদের মধ্যকার একটি প্রাতঃরাশ বৈঠকের খবর ছড়িয়ে দেয়। এর পরই দেখা যায় ড্যন মজিনা ভারতীয় কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলতে দিল্লি উড়ে গেছেন। মজিনা ঢাকায় ফেরার পরে মার্কিন দূতাবাসের সূত্র উদ্ধৃত করে মিডিয়া ইঙ্গিত করেছে যে, ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশ প্রশ্নে একই অবস্থানে ছিল। ওই প্রতিবেদনগুলো দেখে হতাশ ভারতীয় হাইকমিশন ও ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে। অজ্ঞাতনামা ভারতীয় কূটনীতিকদের উল্লেখ করে ঢাকার স্থানীয় মিডিয়া রিপোর্ট করেছে যে, ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র একই অবস্থানে ছিল না (নট অন দ্য সেম পেজ)। ঘরোয়া ভাবে ভারতীয় কূটনীতিকরা সংবাদিকদের বলেছেন মজিনা বিএনপি’র স্থায়ী কমিটির সদস্যের মতো আচরণ করছিলেন। তাদের মতে, তিনি (মজিনা) এতটাই ব্যাকুলতা দেখান যে, বিএনপিকে ক্ষমতায় ফিরিয়ে আনতে তিনি সব কিছুই করবেন। আর খালেদা রাজপথের সহিংসতার মধ্য দিয়ে শেখ হাসিনার সরকারকে টেনে নামাতে দৃঢ়সংকল্পবদ্ধ। খালেদা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দ্বারা উৎসাহিত হয়ে জামায়াত ইসলামের সহায়তায় রাজপথের সহিংসতা বাড়িয়ে চলছেন।’’ এরকম একটি মনোভাবের প্রেক্ষাপটে গতকালের ভারতীয় বিবৃতিকে একটি বড় অবস্থানগত পরিবর্তনের ইঙ্গিতবহ হিসেবে দেখা হচ্ছে।
বাংলাদেশে নির্বাচন নিয়ে একটা তীব্র কূটনৈতিক যুদ্ধ চলছে বলে ভারতীয় গণমাধ্যম থেকে আভাস পাওয়া যাচ্ছিল। মজার বিষয় হচ্ছে- একই খবর দু’-তিন রকম সূত্রে বাজারে পাওয়া যাচ্ছিল। টাইমস অব ইন্ডিয়ায় ইন্দ্রানী বাগচী তার প্রতিবেদনের শুরুতে ভারতীয় সূত্রের বরাতে লেখেন, ‘প্রকাশ্যে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রকে একই অবস্থানে দেখা গেলেও বাংলাদেশে নির্বাচন প্রশ্নে তাদের মধ্যে দ্বৈরথ দেখা দিয়েছে।’ আবার এই একই কথা সুবীর ভৌমিক একটু ঘুরিয়ে মার্কিন দূতাবাস সূত্রের বরাতে প্রচার করেন। তিনি লিখেছেন, ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র একই অবস্থানে রয়েছে বলে যে খবর প্রচারিত হয়েছে তা দেখে ভারতীয় কূটনীতিকরা অবাক হন। তারা লক্ষ্য করেন যে, ভারত এবং ঢাকায় তাদের শ্রেষ্ঠ বন্ধু আওয়ামী লীগ- যারা ভারতের নিরাপত্তা এবং কানেক্টিভিটির মতো বিষয় ভারতের হাতে তুলে দিয়েছে- তাদের মধ্যে বিশ্বাসের ফাটল ধরানোই যুক্তরাষ্ট্রের লক্ষ্য। সুবীর ভৌমিক আরও লেখেন, বিরোধিতার যে রাজনীতির মুখোমুখি শেখ হাসিনা হয়েছেন তার প্রতি চোখ রেখেও ভারতীয় কূটনীতিকরা হাসিনা সরকারের ব্যাপারে অত্যন্ত উৎসাহিত না হয়ে পারেন না। এর পরে তিনি ওকালতি করেন, ঢাকায় যদি ওয়াশিংটনের বন্ধু বেছে নেয়ার অধিকার থাকে তাহলে সে কিভাবে ভারতের বন্ধু বেছে নেয়ার অধিকার অস্বীকার করতে পারে? তাঁর আরও যুক্তি, মর্কিন যুক্তরাষ্ট্র মনে করে বিএনপি নেতৃত্বাধীন একটি সরকার তার কৌশলগত স্বার্থ পূরণ করতে পারে। চীনারা যাতে বাংলাদেশে আসন গেড়ে বসতে না পারে সে ব্যাপারে তারা সাহায্য করতে পারে। বিএনপি’র বিষয়ে ভারতের আপত্তি রয়েছে। কারণ ২০০১ থেকে ২০০৬ সালের মধ্যে বিএনপিকে বাগে আনতে ভারতের প্রয়াস ভেস্তে গিয়েছে। দিল্লির জন্য প্রকৃত ভয় হচ্ছে জামায়াত ইসলামী ও হেফাজতে ইসলাম। সুবীর ভৌমিকের প্রতিবেদন অনুযায়ী- একজন অজ্ঞাতনামা ভারতীয় কূটনীতিকের মন্তব্যকে তিনি নিজেই ‘বিস্ময়কর’ বলে বর্ণনা করেন। সেটা হলো ঢাকার চীনা রাষ্ট্রদূতের উদ্যোগকে ভারত গঠনমূলক বলে বর্ণনা করে। চীনা দূতাবাস ইতিমধ্যেই তিনটি বিবৃতি দিয়েছে। ওই ভারতীয় কূটনীতিকের ভাষায় চীন ‘উভয় দলে থাকা আমাদের বন্ধুদের’ মাধ্যমে বিরোধ মীমাংসার চেষ্টা করছে।
হোয়াইট হাউসে: গত ৮ই নভেম্বর ওয়াশিংটন থেকে ভারতের সরকার পরিচালিত সংবাদ সংস্থা পিটিআই খবর দিয়েছিল যে, হোয়াইট হাউসে ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং বাংলাদেশ বিষয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার কাছে যে উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন সে বিষয়টি বারাক ওবামার গুরুত্বের সঙ্গে গ্রহণ করেছেন। বাংলাদেশের রাজনৈতিক সঙ্কট বিষয়ে ওবামা তার কর্মকর্তাদের আলোচনার পরামর্শ দিয়েছেন। ওই খবরটিতে বলা হয়েছিল, নয়া দিল্লি যদিও মার্কিন কর্মকর্তাদের কাছ থেকে শুনতে পেয়েছিল যে, তারা ঢাকায় খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিরোধী দলের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখতে অধিকতর উষ্ণতা অনুভব করেন।
পিটিআই বলেছে, মনমোহন সিং ব্যক্তিগতভাবে বারাক ওবামার কাছে বাংলাদেশের সঙ্কট বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন। তবে ঢাকার পর্যবেক্ষকরা সকৌতুকে মন্তব্য করেন যে, তারা বাংলাদেশ বিষয়ে মনমোহন সিং ব্যক্তিগতভাবে বারাক ওবামাকে কি বলেছেন তা প্রকাশ করতে না পারলেও বারাক ওবামা দু’মাস পরে তার কর্মর্তাদের কি বলেছেন, তা পেরেছে প্রকাশ করতে। এটা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে প্রকাশ পায়নি।
গতকাল ঢাকায় ভারতীয় হাই কমিশনের যে বিবৃতি প্রকাশ পেয়েছে তাতে ব্যবহার করা তিনটি শব্দের সঙ্গে গত ৮ই নভেম্বর পিটিআই পরিবেশিত প্রতিবেদনের দু’টি শব্দের মিল রয়েছে। পিটিআই-এর খবরে বলা হয়েছিল, যুক্তরাষ্ট্র ভারতকে বলেছে বাংলাদেশের নির্বাচন হতে হবে ‘‘ফ্রি, ফেয়ার অ্যান্ড ক্রেডিবল”। গতকাল ভারতীয় হাই কমিশনের বিবৃতিতে নির্দিষ্টভাবে ‘ফ্রি অ্যান্ড ফেয়ার’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়। এতে উভয়ের অবস্থান কাছাকাছি এলো।
No comments:
Post a Comment